নাজমুল হকের দোয়াত বাড়ি by আব্দুল্লাহ ইফ্ফাত

ব্যাবসায়ী নাজমুল হক মন্টু তার বাড়ির নাম রেখেছেন-দোয়াত বাড়ি। বাড়ির নাম যদি হয় এমন, যে কারও ভাবনায় পড়ার কথা। মাথা গলিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলে তবেই বোঝা যায় আসল ঘটনা। ঘরময় সাজানো আছে বিলুপ্ত সব দোয়াত-কলমের কালি রাখার দোয়াত। ঘরে সারি করে রাখা শোকেস ভর্তি শুধু দোয়াত আর দোয়াত, তাক বোঝাই দোয়াত, চেয়ার টেবিলে দোয়াত। কিছুদিন আগেও আমরা কাঁচের দোয়াত থেকে কলমে কালি পুরে তার পর


লিখতাম। এখন খুঁজলে পাওয়া যাবে সেই সব কালির দোয়াত। তবে আমাদের চেনা কাঁচের দোয়াত নেই তার সংগ্রহে। চেনা জানা দোয়াতের যাও দু'একটা রেখেছেন তার গড়ন শৈলী একেবারেই বিচিত্র।
দোয়াত বাড়িতে আছে শতবছরের অধিক পুরনো সব দোয়াত। দুর্লভ দোয়াতগুলো নানা রকম, নানা গড়নের। গোলাকার, কোনাটা চারকোনা, ছয়কোনা, কামরাঙ্গা, হৃদয় আকৃতির দোয়াত, কলসী, হাঁড়ি, বাক্স কত রকমের গড়নের দোয়াত যে আছে এখানে! দোয়াতগুলো দেখে বোঝা যায়, তখন প্রতিটি দোয়াতের গায়েই থাকত নকশা, বিভিন্ন ধরনের। তবে ফুল-লতা-পাতা কল্কার নকশাই আছে বেশি।
নাজমুল হকের সংগ্রহের মধ্যে আছে তামা, পিতল, কাঁসা, জিংক, দস্তা, জার্মান সিলভার, ক্রিস্টাল, কাচ, সিরামিক, শ্বেতপাথর, মার্বেল পাথর, স্টিলের দোয়াত। এমনকি মাটির দোয়াতও বাদ যায়নি তার সংগ্রহ থেকে। তার কাছে মূল্যবান সংগ্রহ হচ্ছে একটি রূপার দোয়াত। তার সঙ্গে আছে একটি রূপার কলমও। মজার বিষয় বেশির ভাগ দোয়াতই বিশেষ কায়দায় তৈরি। দোয়াত কাত হয়ে পড়ে গেলেও তা থেকে কালি পড়বেনা।
বিশাল এই সংগ্রহ কিভাবে সম্ভব হলো তা জানতে চাইলে নাজমুল হক বলেন, '১৯৮৩ সালে মুদ্রা সংগ্রহ দিয়ে আমার সংগ্রহের যাত্রা শুরু আমার শৈশব কেটেছে পাবনায়। সেখানে মজার একটা বিষয় দেখেছি। অনেকেই সংগহের নেশায় ব্যস্ত থাকতেন। মুদ্রা সংগ্রহের নেশায় পেয়ে বসে আমাকে। কাঁসারীর দোকান, ভাঙ্গাড়ির দোকান থেকে সংগ্রহ করি মজার মজার সব মুদ্রা। একদিন কাঁসারীর দোকানে মুদ্রা কিনতে গিয়ে চোখে পড়ে ল্যাম্পের মতো একটি বস্তু। আগ্রহ নিয়ে দেখতেই দোকানি জানালেন এটি হচ্ছে দোয়াত। পিতলের এই দোয়াতটি দেখে আমার অচেনা মনে হয় এবং পছন্দ হয়ে যায়। এটি কিনতে চাইলে দোকানী বেচতে অস্বীকৃতি জানায়। অনেক বুঝিয়ে সেই দোয়াতটি কিনে আনি পাঁচ টাকা দিয়ে। তারপর একের পর এক দোয়াতের সন্ধান পেতে থাকি আর বৃদ্ধি করি সংগ্রহ।'
দোয়াত কলমের একটা প্রদর্শনী করে নিজামুল হক, ১৯৭৮ সালে। সেই মেলায় দর্শকের আগ্রহের কারণে দোয়াতের প্রতি ভালোবাসাটা আরো বৃদ্ধি পায়। শুরু হয় দ্বিগুণ আগ্রহে দোয়াত সংগ্রহের কাজ। এখানে ওখানে খুঁজলেই দুএকটা মিলে যায়। আবার শূন্যহাতেও ফিরতে হয় কখনও। এমনই এক গল্প শোনালেন নাজমুল হক মন্টু। একবার খবর পেলেন দূরগ্রামে একজনের কাছে অ্যান্টিকের সংগ্রহ আছে। সেখানে আছে কয়েকটি দোয়াত। কিন্তু সেই গ্রামে যাওয়ার কোনো পথ নেই। শেষ-মেশ সাঁতরিয়ে উঠলেন গিয়ে সেই গ্রামে। লোকটার কাছে অ্যান্টিক অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু দোয়াত ছিল না একটিও। সেই স্মৃতি মনে করে নাজমুল হক প্রায়ই হেসে ফেলেন।
দোয়াত সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেন একজন দোয়াতকে কুপি বাতি হিসেবে ব্যবহার করছেন। কেউ আবার হুক্কার নিচের অংশ কালির দোয়াত হিসেবে ব্যবহার করেছেন। একজন আবার কালির দোয়াতকে হুক্কা বলছেন।
বর্তমানে নাজমুল হক একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন মূল্যবান এই সংগ্রহ। তাই দিয়ে মিরপুরের পল্লবীতে নিজের বাড়ির একটি কক্ষ সাজিয়েছেন জাদুঘরের আদলে। প্রতিদিন এই বাড়িতে শিক্ষার ইতিহাস জানার জন্য আসেন বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ইতিহাসবিদরা। এখানে এসেছিলেন প্রত্নবিশারদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। তার সংগ্রহ দেখে মোহাম্মদ যাকারিয়া প্রশংসা করেছেন। অনেকটা গুছানো না হলেও নাজমুল হকের সংগ্রহ আমাদের শিক্ষার ইতিহাস অনেক দূর পর্যন্ত বলতে পারেন। এই নিয়ে নাজমুল হক মন্টুর সহজ জবাব, 'আমার কাজ আমি করেছি, এখন বাকিটুকু দেখার বিষয় ইতিহাসবিদ ও সরকারের।' আমাদের দেশে বিষয়ভিত্তিক অনেক জাদুঘর আছে। শিক্ষা বিষয়ে কোনো জাদুঘর নাই। এ বিষয়ে কেউ গবেষণা করতে চাইলে দেশের সব জাদুঘর ও লাইব্রেরি খুঁজে বেড়াতে হয়। শিক্ষা বিষয়ক জাদুঘর গড়তে চাইলে নাজমুল হক পূর্ণাঙ্গ সহায়তা করবেন বলে মত দিয়েছেন। দোয়াত থাকলে দোয়াতে ব্যবহৃত কলম যাবে কোথায়! এর সঙ্গে খাকের ও পালকের কলমও আছে তার সংগ্রহে। আরও আছে দুষ্প্রাপ্য পুঁথি। সব মিলিয়ে শিক্ষার পূর্র্ণাঙ্গ সংগ্রহ। হ

No comments

Powered by Blogger.