আজীবন সম্মাননা পেলেন আবদুল জব্বার by এসএম মুন্না,

নির্জন যমুনাপাড়ে হঠাৎ আলো ঝলমলে পরিবেশ। হাজারো শিল্পী আর দশ সহস্রাধিক দর্শক-শ্রোতার কলরব, বহতা যমুনাও যেন এ আনন্দযজ্ঞে শামিল। সপ্তম সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস ঘিরে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় যমুনার পূর্বপাড়ে বসেছিল এক মিলনমেলা। এ অনুষ্ঠানেই দেওয়া হয় সঙ্গীতে ১৫ ক্যাটাগরিতেপুরস্কার। অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার পাশাপাশি ছিল নানা আয়োজন। অংশ নেন দেশের খ্যাতিমান শিল্পীরা। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা


অবদান রেখেছেন মনোমুগ্ধকর এ অনুষ্ঠানে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সম্মাননা জানানো হয় বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল এবং শ্রীলংকার শিল্পীদের।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই থিয়েটার পালাকারের মুক্তিযুদ্ধনির্ভর ফিল্ডড্রামা মঞ্চস্থ হয়। যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ও এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্রের অংশবিশেষ তুলে ধরা হয়। এর পর মঞ্চজুড়ে তুলে ধরা হয় আমাদের অহঙ্কারের লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা। ধীরে ধীরে সে পতাকা সরে যেতেই মঞ্চে আসেন অনুষ্ঠানের দুই উপস্থাপক আফজাল হোসেন ও ফারজানা ব্রাউনিয়া। শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। প্রখ্যাত গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের নেতৃত্বে একঝাঁক যন্ত্রী ও শিল্পী পরিবেশন করেন 'স্বদেশ আজ বিজয় উল্লাসে'।
এরপর মঞ্চে আসে ব্যান্ডতারকা আইয়ুব বাচ্চুর নেতৃত্বে উচ্চারণ, আর্টসেল, শহরতলী, শূন্যসহ ১০টি ব্যান্ড দল। তারা পরিবেশন করে জর্জ হ্যারিসনের সেই ঐতিহাসিক কনসার্টের বিখ্যাত 'বাংলাদেশ বাংলাদেশ...' গানটি। এরপর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গীত পরিবেশন করতে আসেন শিল্পী সুজেয় শ্যাম, ফকির আলমগীর, রফিকুল আলম, অনুপ ভট্টাচার্য, রূপা খান, মালা খুরম, উমা খান, তিমির নন্দী, বুলবুল মহলানবিশ ও কল্যাণী ঘোষ। 'বিজয় নিশান উড়ছে ওই..., উড়ছে উড়ছে বাংলার ঘরে ঘরে' গানটি পরিবেশন করেন শিল্পীরা।
ক্ষুদে গানরাজ ও সুরদরিয়া বাঘাগাইনের পাঁচ শিল্পী দেশের গান পরিবেশন করেন। এর পর মঞ্চে আসেন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী মেহবুব চৌধুরী। তারা যৌথভাবে আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত শিল্পীর নাম ঘোষণা করেন। এবার আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন শিল্পী আবদুল জব্বার। তার হাতে তুলে দেওয়া হয় সপ্তম সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসের আজীবন সম্মাননা ক্রেস্ট ও নগদ দুই লাখ টাকা।
এর পর প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
আজীবন সম্মানাপ্রাপ্ত আবদুল জব্বার তার অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, আমার জীবনের দুটি স্মরণীয় স্মৃতি বা আনন্দ রয়েছে। একটি ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় একই মঞ্চে। অন্যটি আজকের মঞ্চে আমাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করায়।
পরে দেখানো হয় সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসের ওপর নির্মিত ১০ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র। চর্যাপদ নিয়ে মঞ্চে আসেন শিল্পী সাদি মহম্মদ, লিলি ইসলাম, শ্যামা আলী, ইন্দ্রাণী কর্মকার, অভীক দেবনাথ।
এর পর শ্রদ্ধা জানানো হয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রবিশংকরের প্রতি। সম্মাননা জানানো হয় ভুটান, নেপাল, ভারত ও শ্রীলংকা থেকে আসা শিল্পীদের। পঞ্চকবির গান নিয়ে মঞ্চে আসেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফেরদৌস আরা, পাপিয়া সারোয়ার, রোকাইয়া হাসিনা ও অদিতি মহসীন। পরে ভুটান থেকে আসা নৃত্যশিল্পী দল পরিবেশন করে মনোজ্ঞ লোকজ নৃত্য। এ পরিবেশনার পর শুরু হয় পুরস্কার প্রদান পর্ব।
পুরস্কার প্রদান :রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগে ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ইফফাত আরা দেওয়ান ও পপুলার অ্যাওয়ার্ড নন্দিতা ইয়াসমিন। নজরুলসঙ্গীত বিভাগে ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ড. নাশিদ কামাল ও পপুলার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তানভীর আলম সজীব। তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন সাদি মহম্মদ, রূপা খান, ফেরদৌসী রহমান, ফেরদৌস আরা ও তিমির নন্দী। এ সময় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পরিবেশন করেন বিগত বছরে সিটিসেল-চ্যানেল আই অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত শিল্পী সজীব, সুমনা বর্ধন, মাহাদী ও সিঁথি। এর পর পরিবেশিত হয় শ্রীলংকার নৃত্যশিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা।
উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বিভাগে ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, মালা খান, তৌফিক নেওয়াজ। এর পর ছায়াছবির দুটি গানে পারফর্ম করেন নায়করাজ রাজ্জাক, অঞ্জনা, ফারুক ও রোজিনা। মরমী সঙ্গীত পরিবেশন করেন কিরণচন্দ্র রায়, সেলিম চৌধুরী, শাহনাজ বেলী, আকরামুল ইসলাম ও ফরিদা পারভীন।
পরে নেপালের নৃত্যশিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনার পর ঘোষণা করা হয় শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক বিভাগে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। এ বিভাগে গীতিকারের পুরস্কার পেয়েছেন জুলফিকার রাসেল ও পপুলার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন রবিউল ইসলাম জীবন। সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন শফিক তুহিন ও পপুলার চয়েজ পেয়েছেন ইবরার টিপু। তাদের পুরস্কৃত করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুজেয় শ্যাম, মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও বুলবুল মহলানবিশ।
পরে লোকগীতি পরিবেশন করেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী, আসগর আলীম, চন্দনা মজুমদার। এ সময় ঘোষণা করা হয় শ্রেষ্ঠ লোকসঙ্গীত ও শ্রেষ্ঠ আধুনিকসঙ্গীত বিভাগে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। এ বিভাগে শ্রেষ্ঠ লোকশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন কিরণ চন্দ্র রায় ও পপুলার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন রামকানাই দাস। শ্রেষ্ঠ আধুনিক সঙ্গীতের পুরস্কার পেয়েছেন আসিফ ইকবাল ও পপুলার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সুমনা বর্ধন। তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন ফরিদা পারভীন, ফকির আলমগীর, সৈয়দ আবদুল হাদী ও উমা খান।
ভারতের নৃত্যশিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনার পর মঞ্চে আসেন মৌসুমী, ওমর সানী, ফেরদৌস, মিশা সওদাগর, নিপুণ, সজল, মীম। ছায়াছবির চারটি গানে পারফর্ম করেন তারা। ছায়াছবি ও নবাগত শিল্পী বিভাগে 'জীবনের গহীনে' ছবিতে তুমি আমার জীবনের গহীনে আস...গানের জন্য ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও এ বিভাগে পপুলার চয়েজ পেয়েছেন 'আই লাভ ইউ' ছবির গানের জন্য বাপ্পা মজুমদার ও কণা। নবাগত শিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন নাহীদ সুলতানা ও পপুলার চয়েজ পেয়েছেন নিশীথ সূর্য। তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন নায়করাজ রাজ্জাক, কল্যাণী ঘোষ, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও অনুপ ভট্টাচার্য।
অনুষ্ঠানে পপগানের একটি সেগমেন্টে অংশ নেন ফেরদৌস ওয়াহিদ, কনা, হৃদয় খান ও মিলা। এ সময় নাম ঘোষণা করা হয় কভার ডিজাইন ও সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার বিভাগে পুরস্কার বিজয়ীদের নাম। এ বিভাগে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের পুরস্কার পেয়েছেন বাপ্পা মজুমদার ও পপুলার চয়েজ পেয়েছেন সাজ্জাদ আরেফিন। কভার ডিজাইনে পুরস্কার পেয়েছেন তহিদ হাসান ও পপুলার চয়েজ পেয়েছেন সাইফুল ইসলাম তারিফ। তাদের পুরস্কৃত করেন আফজাল হোসেন, মিনু হক, পান্না আজম ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সদস্যরা।
পরপর মঞ্চে আসেন সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, শাম্মী আখতার, মোঃ খুরশীদ আলম, আবিদা সুলতানা ও রিজিয়া পারভীন। তাদের কণ্ঠে ছিল সোনালি অতীতের মিষ্টি কিছু গান। ব্যান্ড সঙ্গীতের মুগ্ধকর পরিবেশনায় অংশ নেয় উচ্চারণ, আর্ক, ফেইস টু ফেইস ও আর্টসেল। এ বিভাগের ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ব্যান্ড দল ডি-ইলিউশন ও পপুলার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ব্যান্ড দল বোহেমিয়ান ও মিউজিক ভিডিওর জন্য ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাজমুস সাদাত ও মিউজিক ডিরেক্টর বিভাগে পপুলার চয়েজ পুরস্কার পেয়েছেন গাজী শুভ্র। পুরস্কার তুলে দেন আইয়ুব বাচ্চু, রফিকুল আলম ও ফিরোজ মাহমুদ। এর পর দলীয় একটি গানে অংশ নেন বালাম, এলিটা, শুভ ও জুহাদ। এ সময় নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, ইবরার টিপু ও সহশিল্পীদের পরিবেশনায় একটি ধ্রুপদী সঙ্গীতের কম্পোজিশন উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে। পরে সহস্র শিল্পী সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে...। এর সঙ্গে মুগ্ধ দর্শক-শ্রোতা আগামীতে আরও একটি মনমাতানো এমন অনুষ্ঠানের স্বপ্ন বুনতে বুনতে শীতের হিমেল হাওয়া মেখে বাড়ি ফেরেন।
এর আগে সকাল ১০টা থেকে অনুষ্ঠানকে ঘিরে যমুনার পূর্বপাড়ে অনুষ্ঠানস্থলে চলে দিনব্যাপী বাংলাদেশ মেলা। বাংলাদেশ মেলায় ছিল_ নানান ধরনের স্টল, সাপ খেলা, নাগরদোলা, যাত্রা, বানর খেলা, হাতি-ঘোড়া, বায়েস্কোপ, রণপা, লাঠি খেলা। স্টলগুলোতে ছিল মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা ইত্যাদি। মেলাজুড়ে জেলে, তাঁতি, বেদে, কামার-কুমার সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। চারু ও কারুশিল্পীদের প্রদর্শনীসহ ছিল সার্কাস। ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরে মহান মুক্তিযুদ্ধের তথ্যচিত্র ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। দিনব্যাপী পরিবেশিত হয় দেশাত্মবোধক ও স্বাধীন বাংলা বেতারের গান। সপ্তম সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শহিদুল আলম সাচ্চু। অনুষ্ঠানটি চ্যানেল আইতে ২ ডিসেম্বর প্রচার করা হবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.