প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ-চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে আবার আইনের খড়গ! by আজিজুল পারভেজ

কে তো ঝিমিয়ে পড়েছে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, তার ওপর আবার নতুন মোড়কে আসছে নিয়ন্ত্রণের খৰ। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সত্ত্বেও বাতিল হয়নি সামরিক শাসনামলে তৈরি করা 'চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ আইন'। ৩০ বছরের পুরনো আইনটি থেকে 'নিয়ন্ত্রণ' শব্দটি বাদ দিয়ে এবং কিছুটা সংশোধন করে নতুনভাবে আইন পাস করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নতুন করে আইন প্রণয়নের খবরে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মীরা বিস্মিত।


তাঁরা আইনের সংস্কার নয়, বরং আইন থাকার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।গত ২৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদে 'চলচ্চিত্র সংসদ (নিবন্ধন) আইন-২০১১' নামের একটি নতুন বিল উত্থাপন করা হয়। 'চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৮০' বিলটি রহিতপূর্বক সংশোধনসহ তা পুনঃপ্রণয়নের উদ্দেশ্য পূরণে এ বিলটি আনা হয়েছে বলে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ সংসদে জানান। তিনি বলেন, 'চলচ্চিত্র সংসদগুলোকে গতিশীল ও সুসমন্বিত করার লক্ষ্যে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের অনুকূল ক্ষেত্র সৃষ্টির জন্য বিদ্যমান আইনের সংশোধন আনা হচ্ছে।' বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর তা আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, পুরনো আইনের 'নিয়ন্ত্রণ' শব্দটি প্রস্তাবিত আইনে থাকছে না। পুরনো আইনের মতো নতুন আইনেও চলচ্চিত্র সংসদের নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, কোনো চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। নিবন্ধনের জন্য ধার্যকৃত ফি দিয়ে নির্ধারিত ফরমে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। ঢাকার বাইরের জন্য জেলা তথ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে বোর্ডের কাছে আবেদন করতে হবে। পুরনো আইনে কোনো চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আগে ফিল্ম সেন্সর বোর্ড থেকে তা সেন্সর করিয়ে নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন আইনে তা বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অন্তত তিন দিন আগে প্রদর্শনীর স্থান, তারিখ ও সময় উল্লেখ করে বোর্ড অথবা জেলা প্রশাসক, ক্ষেত্র মতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানানোর বিধান রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদনকে বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে অননুমোদিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য শাস্তির বিধান বাতিল করে নিবন্ধন বাতিলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ জানুয়ারি জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত একাদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণের 'কালাকানুন' বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সদ্যপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার ও ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি বাদল রহমান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় কালাকানুন বাতিলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এত বছর ধরে কালাকানুনটি বিদ্যমান থাকায় প্রধানমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি সেটি বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বলেন, 'আরো আগে বললে আগেই বাতিল হতো।' কিন্তু এর পরও 'চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন আইন' গত বছর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দিয়ে এ বছর জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে।
৩০ বছর আগে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৮০ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে 'চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৮০' পাস হয়েছিল। বিকাশমান চলচ্চিত্র চর্চা এবং চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কণ্ঠরোধ ও গতিমুখকে স্তব্ধ করার জন্য দমনমূলক আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল বলে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মীদের কাছে আইনটি কালাকানুন হিসেবে পরিচিতি পায়।
আইনটি প্রণয়নের পর পরই প্রতিবাদ জানিয়েছিল চলচ্চিত্র সংসদগুলো। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক চলচ্চিত্রকার বাদল রহমান জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এই আইনের কারণে এ দেশের বিকাশমান চলচ্চিত্র সংস্কৃতির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে।
বর্তমান আইন নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কর্মীরা। মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির বেলায়েত হোসেন মামুন বলেন, 'সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আর কোনো মাধ্যমের সংগঠনের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা নেই। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই খৰ কেন? তিনি বলেন, 'দেশের বিকাশমান চলচ্চিত্র সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এ কালাকানুন করা হয়েছিল। তার কুফল এখনো আমরা ভোগ করছি। এর পরও মনে রাখতে হবে, আমাদের সুস্থধারার চলচ্চিত্রকে যাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন, মাঝেমধ্যে বিদেশ থেকে যাঁরা পুরস্কার আনছেন, তাঁরা সবাই চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন থেকেই উঠে আসা।'

No comments

Powered by Blogger.