তিন ঘণ্টা কিলারদের নজরদারিতে ছিলেন মেয়র লোকমান by পিনাকি দাসগুপ্ত

মৃত্যুর তিন ঘণ্টা আগে থেকেই কিলারদের নজরদারিতে ছিলেন নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন। মোক্ষম সুযোগ না পাওয়ায় তারা কিলিং অপারেশনের স্থান পরিবর্তন করে। ঘটনার দিন ১ নভেম্বর বিকেলে স্থানীয় এক রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যুতে তার পরিবারকে সান্ত্বনা জানাতে নরসিংদী শহরের কুমিল্লা কলোনিতে গিয়েছিলেন মেয়র লোকমান হোসেন। সেখানে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা অবস্থান করেন তিনি। কুমিল্লা কলোনিতে যাওয়ার পর থেকেই লোকমানকে অনুসরণ করতে থাকে কিলাররা।
পরে লোকমান হোসেন ২০-২৫ জন নেতাকর্মী নিয়ে দেড় কিলোমিটার দূরে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের উদ্দেশে হেঁটে রওনা হন। এ দেড় কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করার সময় পথে পথে লোকজন তাকে দাঁড় করিয়ে কথা বলছিলেন। লোকমান ছোট-বড় তাদের কাউকেই সেদিন প্রত্যাখ্যান করেননি। ফলে প্রায় দু'ঘণ্টা সময় লাগে তার জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে পেঁৗছতে। কুমিল্লা কলোনি থেকে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে যাওয়ার মধ্যে কিলাররা একাধিকবার টার্গেট করে। হাঁটা পথে পুরো সময় লোকজন ঘিরে রেখেছিল লোকমানকে। ফলে টার্গেট মিস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। উপরন্তু ছিল ধরা পড়ার ভয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছেন মাসুদ পারভেজ ওরফে টিপ্পন। টিপ্পনের বাড়িও নরসিংদীর কুমিল্লা কলোনি এলাকায়। গতকাল শুক্রবার দ্বিতীয় দফায় চার দিনের রিমান্ড শেষে টিপ্পনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রথম দফায় টিপ্পনকে ৮ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। এর আগে গত বুধবার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান শেষে হাজি সেলিমকে কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে রয়েছে পাঁচ জন। তারা হলেন_ নরসিংদী শহর যুবলীগ সভাপতি আশরাফ হোসেন সরকার, হাজি ফারুক, মাহফুজ হোসেন তাওয়াব ওরফে সবুজ, শাহীন ও নাসির।
তদন্তকারী কর্মকর্তা : গোয়েন্দা পরিদর্শক মামুনুর রশীদ মণ্ডল জানিয়েছেন, টিপ্পনকে দু' দফায় ১২ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার কাছ থেকে লোকমান হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তার দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, টিপ্পনকে যে কোনো সময় আবারও রিমান্ডে আনা হবে।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, লোকমান হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি টিপ্পন। টিপ্পনের দেওয়া তথ্য মতে গ্রেফতার করা হয় যুবলীগ নেতা আশরাফকে। ওই কর্মকর্তা বলেন, যুবলীগ নেতা আশরাফ হোসেন সরকারকে গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিন লোকমান হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি আশরাফের বড় ভাই নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মতিন সরকারও তাদের আয়ত্তের মধ্যে ছিল। টিপ্পনের দেওয়া তথ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে আশরাফকে গ্রেফতার করা হয়। আশরাফকে গ্রেফতারের পর পর আবদুল মতিন সরকার টের পেয়ে যান। পুলিশ পৌঁছার আগেই তিনি পালিয়ে যান। আশরাফের গ্রেফতারের ফলে হত্যার পুরো ছক জানা সম্ভব হয়েছে।
টিপ্পন কারাগারে : নরসিংদী প্রতিনিধি প্রীতিরঞ্জন সাহা জানান, লোকমান হত্যা মামলার সন্ধিগ্ধ আসামি দুর্ধর্ষ ক্যাডার মাসুদ পারভেজ টিপ্পনকে দ্বিতীয় দফা ৪ দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল শুক্রবার নরসিংদী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশিকুল খবিরের আদালতে হাজির করা হয়। ফের রিমান্ডের আবেদন না থাকায় আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। গত ১৪ নভেম্বর টিপ্পনকে প্রথম দফায় ৮ দিনের এবং ২১ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। গত ১৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও নরসিংদী পুলিশ গোপালগঞ্জে গোপীনাথপুর গ্রামের শরিফপাড়া থেকে টিপ্পনকে গ্রেফতার করে। ঘটনার পর টিপ্পন সেখানে আত্মগোপন করেছিল।
নরসিংদী পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদউদ্দিন জানান, জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের মামলায় আর কোনো আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি। রিমান্ডকৃত আসামিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তদন্ত কাজে কোনো রকম গাফিলতি করা হবে না।
বিচার দাবি : বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেছেন, মেয়র লোকমান হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। প্রকৃত খুনিদের আড়াল করে অযথা কাউকে যেন হয়রানি না করা হয়। তিনি গতকাল শুক্রবার শিবপুরের ইটাখোলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমনের ৪৭তম জন্মদিন উপলক্ষে পুটিয়া ইউনিয়ন বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন। পুটিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জাকির মোল্লার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কাজী সাহেদের পরিচালনায় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জেলা বিএনপির যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক সারোয়ার মৃধা, অ্যাডভোকেট মাসুদুল আলম ভূঞা, জেলা যুবদলের সহ-সম্পাদক জহিরুল হক জুয়েল, যুবদল নেতা আবদুল্লাহ আল মামুন, শ্রমিক নেতা আলাউদ্দিন, বজলুর রহমান মুন্সী, খন্দকার ওমায়ের রায়হান শাহীন, ছাত্রদল নেতা শরীফ আহমেদ প্রমুখ।
কাঙালিভোজ : মেয়র লোকমান হোসেন স্মরণে গতকাল শুক্রবার শহরের কাউরিয়া পাড়ায় পৌর ঈদগাহ ময়দানে এক কাঙালিভোজের আয়োজন করা হয়। পৌরসভার প্যানেল মেয়র জহিরুল ইসলাম জহির, নিহত মেয়রের ভাই ও মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল, ছোট ভাই নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি শামীম নেওয়াজসহ অন্যরা এ কাঙালিভোজের আয়োজন করেন।

No comments

Powered by Blogger.