মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর স্বপ্নযাত্রা by শোয়েব চৌধুরী,

ন্ধ্যা হতে না হতেই রিকশাচালক গফুর মিয়া উপজেলা সদরে যেতে রাজি হলেন না। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ভাড়া নেওয়ার জন্য। এত ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কারণ কী? তার সোজা উত্তর_ 'সাব বাচ্চারে নিয়া স্কুলে যাইমু।' রাতে কী স্কুল? গফুর মিয়া বলেন, 'আমাদের যাত্রাপাশা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে এখন রাইতের স্কুল চালু হইছে। অখন কোনো ট্রিপ না দিয়া বাড়ি গিয়া পোলাটারে লইয়া যাইমু স্কুলে।'


ভাড়া পেয়েই বাড়ির উদ্দেশে দ্রুত রিকশার প্যাডেল মারতে থাকলেন, কোনো যাত্রী না নিয়েই। গফুর মিয়ার মতো বানিয়াচংয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম ইউনিয়নের ধনী-গরিব সব অভিভাবকই এখন সন্ধ্যা হলে বিদ্যালয়ে নিয়ে যান তাদের শিশুদের।
বানিয়াচং হবিগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য উপজেলা। অনেকেই বানিয়াচংকে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে দাবি করেন। যদিও এর সঠিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এটি বাস্তব, বানিয়াচং গ্রামের ভেতরেই রয়েছে চারটি ইউনিয়ন।
কমলারানীর দীঘি, বিথঙ্গলের আখড়া, বিবি মোকাম মসজিদ, হবিব গোমার দারা গুটি, শ্যাম বাউলের আখড়াসহ বহু ইতিহাস, কিচ্ছা-কাহিনী, গাথা রয়েছে বৃহত্তর গ্রাম বানিয়াচংকে ঘিরে। ইতিহাসখ্যাত এ জনপদে আরেকটি নতুন
ইতিহাস শুরু করতে যাচ্ছেন দক্ষিণ-পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী।
বানিয়াচং দক্ষিণ-পশ্চিম ইউনিয়নে ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পাঁচটি বিদ্যালয়েই শুরু হয়েছে সন্ধ্যাকালীন ক্লাস। চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীর স্বপ্ন, তার ইউপির প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে উঠবে একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তার ইচ্ছা, বাড়ির পরিবর্তে শিশুরা লেখাপড়া শেষ করবে বিদ্যালয়ে। সব শিশুর হাতের লেখার অক্ষর হবে একই রকম। বাড়ি হবে শিশুদের অভিভাবক আর স্বজনদের সঙ্গে অবসর কাটানোর স্থান।
স্বপ্ন যখন সত্য : চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। '৭১-এ তিনি ছিলেন কলেজছাত্র। দেশকে স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে গিয়েছিলেন যুদ্ধে। ৬০ বছর বয়স্ক প্রবীণ এ মুক্তিযোদ্ধা এবার নেমেছেন তার ইউনিয়নে সব শিশুকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার যুদ্ধে। এবার ইউপি নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে ১০ সেপ্টেম্বর তার ইউপির ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে যান রংপুরের গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে জেনেছেন পাঠদানের নিয়ম-কানুন, শিশুদের বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার কায়দা, হাতের লেখা সুন্দর করার নিয়ম। জেনেছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী শিবরাম আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আরও গোপন রহস্য। এক্ষেত্রে শিবরাম বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরুল আলম যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। নূরুল আলম এর আগে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের আমন্ত্রণে হবিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, শিবরাম থেকে ফেরার পথে আমরা গাড়িতেই এ নিয়ে আলোচনা করি। সাগরদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাইউম এ আয়োজনে পিছিয়ে থাকবেন বলে মন্তব্য করেছিলাম; কিন্তু তিনিই সফরের তিনদিন পর ১৮ সেপ্টেম্বর তার বিদ্যালয়ে শুরু করেন সান্ধ্যকালীন ক্লাস। শিক্ষক আবদুল কাইউম চালু করেছেন শুনে স্বরূপখানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যাত্রাপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রায়েরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হেদায়েতউল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আর বসে থাকেননি। তারাও একে একে বিদ্যালয়ে চালু করেন সান্ধ্যকালীন শিফট। তবে তারাসই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা চালু করা যায়নি আলোর অভাবের কারণে। আলোর ব্যবস্থা করেই এ বিদ্যালয়কে এর আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে। সান্ধ্যকালীন বিদ্যালয়ে নিজ নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়াও কমিউনিটি শিক্ষকরা (এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবক) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ক্লাস নেন। ওই শিফটে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের পাঠদান ও আদায় করা হয়। তিনি আরও জানান, পাঁচটি বিদ্যালয়ে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীর অভিভাবকের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সাড়া পাওয়া গেছে। দিনের স্বাভাবিক উপস্থিতির তুলনায় সান্ধ্যকালীন শিফটে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিও বেশি। সন্ধ্যা হলেই শিশুরা অভিভাবকদের হাত ধরে আসে বিদ্যালয়ে। শিশুদের বই-খাতা এখন আর বাড়িতে নিতে দেওয়া হয় না। সবকিছু থাকে বিদ্যালয়েই।
স্বরূপখানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাদির বক্ত সোহেলী জানান, আমাদের বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল না। শিশুদের লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে সম্প্রতি গ্রাম্য পঞ্চায়েত ৪৫ হাজার টাকায় সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছে। জানা গেছে, নাইট স্কুলের শিক্ষকদের সম্মানীও পঞ্চায়েত থেকেই ব্যবস্থা করা হবে।
যাত্রাপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা না থাকলেও অভিভাবকরা চার্জার লাইট কিনে দিয়েছেন প্রতিটি শিশুতে। এর আলোতেই চলে ক্লাস। প্রতিটি ক্লাসে রয়েছেন দু'জন করে শিক্ষক।
স্বরূপখানী গ্রামের কাওছার মিয়া বলেন, এ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় এখন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাইভেট শিক্ষক প্রয়োজন হয় না। শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগও বেড়েছে। ধনী-গরিব সব শ্রেণীর অভিভাবকের মধ্যে সাড়া ফেলেছে ।
চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, তিনি প্রতিদিন কোনো না কোনো বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী ওয়ার্ড মেম্বাররা তাদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের সালাম জানিয়ে আসেন। প্রথম অবস্থায় অন্যান্য ইউপির কয়েকজন চেয়ারম্যান সান্ধ্য বিদ্যালয় চালু নিয়ে টিপ্পনী কাটলেও তারাও এখন জনগণের চাপের মুখে আছেন। এ ব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারে তারাও চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানা গেছে। এদিকে এ প্রয়াসকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঢাকায় বসবাসরত বানিয়াচংয়ের কয়েকজন শিল্পপতি ও ব্র্যাকের প্রধান ফজলে হাসান আবেদ সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। বানিয়াচংয়ের ইউএনও দেবজিৎ সিংহ বলেন, এ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এর সাফল্য দেখে পরে বাকি ইউনিয়নগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তা চালু করা যায় কি-না তা বিবেচনা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.