শীতলক্ষ্যার তীরে দেশের অগ্নিপরীক্ষা by আমেনা মহসিন

ফলভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান কি সাধারণ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটির নিষ্পত্তি করে দিয়ে গেল? এটা কি বলা চলে যে, যেহেতু এ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে ভালোভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাই সংসদ নির্বাচনের সময়ও কোনো সমস্যা হবে না? আমার মনে হয়, এভাবে দেখা খুবই সরলীকরণ হয়ে যাবেনারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। জয়ী হয়েছেন সেলিনা হায়াৎ


আইভী এবং বলা যায়, গোটা দেশ তাকে অভিনন্দনে সিক্ত করছে। নবগঠিত একটি সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র হওয়া গৌরবের, কিন্তু তিনি যেভাবে দেশ-বিদেশে নিজের একটি স্বচ্ছ-নিষ্কলঙ্ক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পেরেছেন_ সেটা আরও বড় পাওনা। দেশবাসী আশা করবে, মেয়র হিসেবেও তিনি সফল হবেন। দলের নয়, চারপাশের ঘনিষ্ঠজনদেরও নয়, জনগণের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন সব মহলের বিশেষ নজরে আসতে পারল, সে প্রশ্ন অনেকেই করছেন। প্রথমত, এ শহরটি রাজধানী ঢাকার একেবারে লাগোয়া। সদ্য ঘোষিত সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র কে হচ্ছেন, এর প্রতি এক ধরনের আগ্রহ থাকে।
দ্বিতীয়ত, এ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট মনে রাখতে হবে। পরপর কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান সংশোধন করেছে। বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং তাদের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদানই এ জন্য যথেষ্ট। তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এভাবেই অনুষ্ঠানের বিষয়ে দৃঢ়পণ। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের মিত্র কয়েকটি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের জন্য রাজপথে সক্রিয় রয়েছে। তারা এ জন্য সংবিধান ফের সংশোধনের দাবি তুলেছে। এ প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সৃষ্টি করপোরেশন নির্বাচন ছিল এক ধরনের টেস্ট কেস। নির্বাচন কমিশন এবং সরকার উভয়েই এক ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিল শীতলক্ষ্যার তীরে। সঙ্গত কারণে দেশবাসীও বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হয়েছে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এ নির্বাচনের বিষয়টি প্রথম থেকেই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। মিডিয়া প্রতিদিনই ছোট-বড় নানা ইস্যু তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে। এসব কারণে স্থানীয় সরকারের একটি নির্বাচনও জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পেরেছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে চলেছে। দেশের আইনেও এমনটিই বলা আছে। এরপরও দেখা যায়, প্রধান দলগুলো এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্য পদেও দলীয়ভাবে মনোনয়ন দিতে তৎপর হয়। নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের বেশিরভাগের তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকে। নারায়ণগঞ্জেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মেয়র হিসেবে যে তিনজন প্রার্থী ব্যাপক আলোচনায় ছিলেন, তারা এলাকায় অবস্থান করেন এবং এলাকার বাইরেও তাদের রয়েছে যথেষ্ট পরিচিতি।
তাদের মধ্যে দু'জন সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়। তারা নির্বাচনে লড়তে অনমনীয় ছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী তাদের সঙ্গে বৈঠক করেও একজন প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেননি। তবে কারও কারও মনে হয়েছে, দলটি এক ধরনের কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তারা জনপ্রিয় মুখ সেলিনা হায়াৎ আইভীকেও মাঠে রেখেছে, আবার শামীম ওসমানকেও দূরে ঠেলে দিতে চায়নি। এলাকায় দু'জনের ভাবমূর্তি বলা যায় বিপরীতধর্মী এবং রাজনীতির প্রয়োজনে কাউকেই হয়তো তারা বাদ দিতে চায়নি। শামীম ওসমান যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে খুব একটা আকর্ষণীয় মুখ নয়, সেটা দলীয় হাইকমান্ড জানে না, এমন নয়। কিন্তু তার রয়েছে 'অশেষ সাংগঠনিক ক্ষমতা', যা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার জন্য অপরিহার্য_ এমন মত নেতৃত্বের মধ্যে অনেকের রয়েছে। নির্বাচনে যদি কালো টাকার খেলা মুখ্য হয়ে ওঠে এবং 'জোর যারা মুল্লুক তার' পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাহলে তিনি হয়তো যোগ্য প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হতেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে বেশ কয়েকজন নেতা এবং তাদের অনুগামী অনেকে শামীম ওসমানের পক্ষে সরাসরি কাজ করেছেন। অন্যদিকে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষেও সংসদ সদস্য কবরী এবং জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এসএম আকরামসহ অনেকে কাজ করেছেন। শামীম ওসমানকে 'দলীয় প্রার্থী' ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু অন্য প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করার কারণে কাউকে দল থেকে বাদও দেওয়া হয়নি। আবার সরকারের তরফ থেকেও দেখানো হরেয়ছে যে, তারা নিরপেক্ষ। স্থানীয় প্রশাসন যথেষ্ট নিরপেক্ষতা দেখাতে পেরেছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্যায়ের দিনগুলো ছিল শান্তিপূর্ণ। সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে নানা মহল থেকে দাবি ওঠায় নির্বাচন কমিশন শেষ দিকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। এ জন্য পরিপত্রও জারি করা হয়। তবে সরকার দেখাতে চেয়েছে, সেনাবাহিনী ছাড়াও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। কোনো অঘটন না ঘটায় তারা এখন জোর গলায় সাফল্য দাবি করতে থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন না হলেও বিপুলসংখ্যক ভোটার উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছেন এবং নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরও কোনো গোলযোগ ঘটেনি।
নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে চেয়েছে এবং তারা এ জন্য প্রস্তুতও ছিল। ভোটারদের প্রত্যাশাও ছিল অনুরূপ। কেন সরকার নির্বাচন কমিশনের অনুরোধ উপেক্ষা করল, সে প্রশ্ন উঠছে। সংবিধানের ১২০ ও ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বলা যায়, সরকার সংবিধানের বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করেনি। নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে সরকারের ভূমিকা ভালো ছিল, এ ক্ষেত্রে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল বিষয় হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী চেয়েছে কিন্তু সরকার তা আদৌ আমলে নেয়নি। আমরা দেখেছি, বেসামরিক সরকারের সহায়তায় নানাভাবে সেনাবাহিনীর সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়া হয়। সরকার সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারলেও সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তারা সেটা করেনি। এ কারণেই সংবিধান লঙ্ঘনের কথা এসেছে। এ প্রেক্ষাপটেই আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে_ স্বাধীন নির্বাচন কি আদৌ সম্ভব?
নির্বাচন কমিশনের অভিমত নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তারা বলেছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন না হওয়ায় কোনো অঘটন ঘটলে তারা দায়িত্ব নেবে না। এ ধরনের মন্তব্য তারা করতে পারে না। নির্বাচকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় তাদের ভূমিকা রয়েছে। আর তাদের পরামর্শ বা অনুরোধ সরকার না মানলে তাদের উচিত ছিল দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো।
বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও সরকারের ব্যর্থতা কম নেই। সবাই যেন নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকে তার জন্য সরকারের করণীয় রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা সফল হয়নি। সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান নির্বাচনের সময় জঙ্গি হামলা হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তার এ সংক্রান্ত মন্তব্যের কারণে ভোটারদের মনে ভয়ভীতির সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু তিনি কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেননি।
তবে সবকিছুর পরও নির্বাচনে জনতার ভূমিকাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও এটা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন। তার নির্বাচিত হওয়া সৎ ও যোগ্য প্রার্থী হিসেবে যারা নির্বাচনে লড়তে চান তাদের উৎসাহিত করবে। রাজনৈতিক দলগুলোও নিশ্চয়ই ভোটারদের এ মনোভাবকে গুরুত্ব প্রদান করবে এবং সেভাবেই প্রার্থী মনোনয়ন দেবে।
সফলভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান কি সাধারণ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটির নিষ্পত্তি করে দিয়ে গেল? এটা কি বলা চলে যে, যেহেতু এ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে ভালোভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাই সংসদ নির্বাচনের সময়ও কোনো সমস্যা হবে না? আমার মনে হয়, এভাবে দেখা খুবই সরলীকরণ হয়ে যাবে। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই কেবল নির্বাচন করবে বলে এখন পর্যন্ত ধারণা করা হয়। সার্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এটা দাবি করে। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের এখনও ধারণা, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই কেবল সুষ্ঠুভাবে সাধারণ নির্বাচন হতে পারে।

স আমেনা মহসিন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
 

No comments

Powered by Blogger.