সহজ-সরল-আমার ভাবনা আমারই মতো by কনকচাঁপা

ই লেখাটা কোনো দিবসে হলে ভালো হতো। কিন্তু দিবসসর্বস্ব দেশের অধিবাসী হয়েও এ দিবসগুলোতে আমার খুব একটা আস্থা নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর_এ দিবসগুলো খুব শ্রদ্ধার, গর্বের, ভালোবাসার। টিকা দিবস, সাদাছড়ি দিবস_এ দিবসগুলোর কর্মসূচি সম্পন্ন করতে পারলে খুবই উপকারী। কিন্তু দিন দিন আরো কত দিবসই না আসছে? তার অর্থ সবাই কী বোঝে জানি না, আমার কাছে এগুলোর তেমন অর্থ দাঁড়ায় না।


যেমন_ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস। বাতাস-পানি যেমন চিরন্তন, মা, বাবা, ভালোবাসাও তাই। আমার জীবন মা-বাবাময়। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার মতো আমি তাঁদের প্রদক্ষিণ করি। তাঁরা আমার প্রতিদিন ভোরে ওঠা সূর্যের মতোই শাশ্বত। আর ভালোবাসা? একদিন ভালোবাসা-মৃত্যু যে তার পর তা-ই যেন হয়_আহা। সেই ভালোবাসা সারা বছরের একটি দিনে জড়ো হয়েছে, তাই কি বাকি দিনগুলোতে গণহত্যা, ধর্ষণ বেড়ে গেল? সম্পর্ক ঘন করার জন্য যদি মা-বাবা দিবস পালন করতে হয়, তবে চাচা, মামা, খালা, ফুপু, শ্বশুর-শাশুড়ি, পাড়ার দোকানের মামু দিবস পালন করা উচিত নয় কি? তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা বড় আলগা হয়ে গেছে যে! এক পাড়ার ছেলে অন্য পাড়ায় গেলেই 'ডাকাত' বলে গণ্য হওয়ার আশঙ্কা_সে রোগা-পটকা দুবলা হলেও। আমরা আর কেউ কাউকে চিনি না। একজন হয়তো বলল, মেরে ফেল_মারো ওকে, তাতে সবাই পুরুষত্ব ফলিয়ে তাকে মেরেই ফেলল_কেউ দেখল না সে কে! দেখবে কিভাবে, চেনে না যে! এই সূত্রে মানুষ চেনা, ডাকাত চেনা, চোর চেনা, পুলিশ চেনা দিবস প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই দিবস পালন করে করে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাই এ থেকে ফেরা যদি সম্ভব না হয় তো চুপিচুপি আরো কিছু দিবস বাতলে দিতে পারি। যেমন_লাঠিপেটা দিবস, মিথ্যে বলা দিবস, ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে মানুষের মাথা সই করে ময়লা ফেলা দিবস, সংসদের গালাগাল অনুকরণ দিবস, পা দিয়ে পাউরুটি বানানো দিবস, বাথরুমে আমের জুস বানানো দিবস, ফরমালিন দিবস, কাজের মেয়েকে ছ্যাঁকা দেওয়ার দিবস, ক্রিকেটারদের মালা দেওয়ার ও গালি দেওয়ার দিবস, দোররা ও এসিড মারার দিবস, নকল ডাক্তারের সত্যি নিবন্ধন দিবস। দুর আমার কান্না পাচ্ছে। আসলে মা-বাবার ভালোবাসা যেমন স্বর্গীয় শান্তি এনে দেয়, তেমনি সামাজিক অবক্ষয়গুলো পা টেনে ধরে কারখানার থিকথিকে বর্জ্যের মতো তরলের তলায় টেনে নিয়ে যায়। অতিসত্বর আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় ঠেকাতে সম্পর্কগুলো ঠিকঠাক গুছিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই আর ভালোবাসার বিশেষ দিবস লাগবে না। আর বৃক্ষরোপণ দিবস? বৃক্ষ উজাড় হয়ে ন্যাড়া হওয়া বাংলাদেশের পুরনো অসুখ। তাই সপ্তাহ নয়, বর্ষাকাল ও তার আগের এবং পরের কিছু সময় নিয়ে প্রায় চার মাস ধরে গাছ লাগানো প্রয়োজন। এ কাজটা আমাদের দেশের শ্রদ্ধেয় প্রকৃতিপাগল বৃক্ষ বিশারদদের দায়িত্ব দিলে তাঁরা ভীষণ ভালোবেসে জাতীয় দায়িত্ব মনে করে পালাক্রমে সারা দেশই গাছে গাছে ভরিয়ে তুলবেন। আমি তাঁদের সঙ্গে থাকতে চাই। আর একটা প্রশ্ন, প্রশ্ন না জিজ্ঞাসা_৮ মার্চ যে নারী দিবস পালন করা হয়, বাকি দিনগুলো কি পুরুষ জাতির? তাদেরও কেন একটা দিবস নেই? তারা কি কোনো অসুবিধায় পড়েন না? শারীরিক দুর্বলতা না হয় নাই থাকল, মনোবৈকল্য তো আছে, অহমিকা আছে_সেগুলো সারানোর জন্য একটা পুরুষ দিবস পালন করলে কেমন হয়? নাকি নারী দিবসের অনুচ্চারিত বাক্য_'যাও, এই এক দিন ধর্ষণ নয়_দোররা নয়_উপবাস নয়_মৃত্যু নয়!' আমি এই নারী দিবসের কর্মসূচি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে চাই, অন্ধকারে নিষ্পেষিত নারীদের জানাতে চাই_আমরা এই পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি, শক্তির আধার, মা। আমাদের মেধা, বুদ্ধি, বিবেচনা, শক্তি, সাহস পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা এনে দেবে_সেটা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। তখন আর গোলাপি রিবনের কোমল আবরণে নারী দিবস পালন করতে হবে না। তখন আমরা শুধুই মানুষ বলে বিবেচিত হব। আমি এভাবেই ভাবি। আমার ভাবনাগুলো আমারই মতো স্পষ্ট ও সরল; কিন্তু সব সময় হয়তো সুন্দর নয়।
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.