একঘরে ২৬ দিন! by কুদ্দুস বিশ্বাস,

সহায় দিনমজুর ঘরের পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। গ্রামের কোনো বাড়িতে যেতে দেওয়া হচ্ছে না ও বাজারের দোকানে কেনাকাটাও বন্ধ করা হয়েছে। গ্রামের কোনো মানুষ ওই পরিবারটির সঙ্গে কথা বলছে না। এমনকি দিনমজুরি হিসেবে কামলাও নেওয়া হচ্ছে না। মাতবরদের দেওয়া এক নির্দেশে ওই আইন জারি করা হয়। গ্রামের যে ব্যক্তি ওই নির্দেশ অমান্য করবে, তাকেও একঘরে করে রাখা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।


ফলে গত ২৬ দিন থেকে অসহায় পরিবারটি চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। গ্রামের মাতবরদের দেওয়া ফতোয়ার এ ঘটনাটি কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার দুর্গম সাজাই বাজারপাড়া গ্রামের।
একঘরে করে রাখা দরিদ্র ওই দিনমজুরের নাম আমির উদ্দিন (৫৫)। রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের সাজাই বাজারপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। ঘরে স্ত্রী, এক ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। সন্তানদের মধ্যে বড় ছেলে জেল হক (২২) কলেজে এবং মেঘনা খাতুন (১৫) ও আফসানা খাতুন (৯) স্কুলে পড়ে। জমাজমি কিছু নাই। দিনমজুরি করে পাঁচ সদস্যের সংসারে খরচ চালায়। দিনমজুরি করতে না পারায় আমির উদ্দিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
জানা গেছে, ২৫ অক্টোবর রাতে কোদালকাটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুছের বাড়িতে এক সালিস বৈঠকে আমির উদ্দিনের মেয়েকে খারাপ, বেহায়া, শরীয়ত পরিপন্থী কাজের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন গ্রামের মাতবর ইউনুস আলী। ওই সব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে পাইকানটারি গ্রামের মসজিদের ইমাম মোসলেম উদ্দিন মুন্সি ওই পরিবারকে একঘরে করে রাখার ঘোষণা দেয়। যত দিন আমির উদ্দিনের মেয়ে 'বেহায়াপনা' বন্ধ না করবে ততদিন ওই রায় কার্যকর থাকবে। আর এ রায় কার্যকর করার দায়িত্ব পালন করেন গ্রামের মাতবর ইউনুস আলী, কোদালকাটি ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য আমিন উদ্দিন, মঞ্জুরুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ভাসানি, সাবেক ইউপি মেম্বার ইব্রাহিম খলিল, আবুল কাশেম দেওয়ানী।
একঘরে করে রাখা পরিবার ও গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, আমির উদ্দিনের স্কুলপড়ুয়া মেয়ে মেঘনা খাতুনের সঙ্গে কড়ই বইশালচরের নজরুল ইসলামের পুত্র ফুল মিয়ার (২২) প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত ১৮ জুলাই মেয়ের বাড়িতে ফুল মিয়া এলে গ্রামবাসী তাকে আটক করে। এলাকার মানুষের চাপে মেয়ের পিতামাতা তাদের দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়। কিন্তু ছেলে পক্ষের আত্মীয়স্বজন তা না মানায় মেয়ে বাদী হয়ে থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে। মামলা করার কারণেই মাতবররা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন পরিবারটির ওপর। কেননা ছেলের আত্মীয়স্বজনরাই হলো ওই সমাজের মাতবর।
শনিবার সরেজমিনে কথা হয় একঘরে রাখা পরিবারটির সঙ্গে। এ সময় আমির উদ্দিন বলেন, 'আমি গরিব মানুষ। কামলা দিয়া যা পাই তা দিয়ে চলে আমার সংসারের খাওয়া-পরা ও বাচ্চাদের লেখাপড়া। গত এক মাস অইল গ্রামের মানুষ আমাকে কামলা হিসেবে নেয় না। ৩ কিলোমিটার দূরের অন্য গ্রামের গৃহস্তদের কামলা দেই। যেদিন কামলা দিতে পারি সে রাতে ভাত খাবার পারি। কয়েকদিন অইল কামলা দিবার পারি না। একবেলা খাবার খেয়ে কাটাইতেছি।' তিনি বলেন, 'গ্রামের মাতবররা বাজারের দোকানিদের কাছ থেকেও কিছু কিনতে দেয় না। হেদিন বাজারের সাইদুলের হোটেল ও আমরুল হোটেলে বইছিলাম দেইখা মাতবর মঞ্জুরুল আমাক ঘর থিকা বাইর কইরা দিছে। ঈদের দিনে কোরবানির মাংসও দেওয়া হয়নি আমাদের।'
আমির উদ্দিনের স্ত্রী জেলেমা বেগম বলেন, 'বাবারে আমগর কেউ নাই। গরিব বইলা আমগর ওপর সবাই অত্যাচার করে। চেয়ারম্যানের কাছে গেলাম, ওনিও মাতাব্বদের কতা শুনবার কয়। আচ্ছা বলেন, আমগর কী অপরাধ? পোলাডা আমার মাইয়ার লগে সম্পর্ক করল। ইজ্জত মারল, নির্যাতন করল, এর বিচার চাওয়া কী আমগর অপরাধ? গ্রামের কোনো বাড়িত গেলে দূর দূর কইরা বাইর কইরা দেয়।'
ওই গ্রামের সবের আলী বলেন, 'ওই দিন সালিস বৈঠকে আমি কথা কইছিলাম বইলা দেওয়ানিরা আমাকেও হুমকি দিছে।' হোটেল মালিক সাইদুল হক ও আমরুল হোসেন স্বীকার করে বলেন, 'আমির উদ্দিন আমাদের হোটেলে বসা দেইখা ওই মাতবররা আমাদের ওপর রাগ করছে। এর পর আর বসার জন্য নিষেধ করছে।'
ওই সালিস বৈঠকের সভাপতিত্বকারী ইউনুস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমির উদ্দিনের মেয়েটি খুবই খারাপ। সে বেহায়া, এদিক ওদিক চলাফেরা করে।' ফতোয়াদানকারী পাইকানটারি গ্রামের মসজিদের ইমাম মোসলেম উদ্দিন মুন্সি ফতোয়া দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'পরিবারটি যদি ভুল স্বীকার করে সমাজের মানুষের কাছে মাফ চায় তাহলে তার বিরুদ্ধে জারি করা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হবে।'
ওই গ্রামের ইউপি সদস্য ও মাতবর আমিন উদ্দিন বলেন, 'পরিবারটি যদি ভুল স্বীকার করে তাহলে এ ঘটনা ঘটে না।' মাতবর মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, 'আপনি বলছেন, আমাদের ঠিক হয়নি। তা হইলে সমাজের সাড়ে ৩০০ পরিবারই খারাপ আর ওই একটা পরিবারই ভালো।'
একঘরে করে রাখার বিষয়ে কোদালকাটি ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম যোদ্দার বলেন, 'আমি ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম না। ঘটনাটি আমি পরে জানতে পেরেছি।'
রাজীবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আজিজল হক বলেন, 'এ ধরনের ঘটনা আমাদের জানা নেই। তা ছাড়া কেউ থানায় অভিযোগ নিয়েও আসেননি। তবুও আমি বিষয়টির খোঁজ নেব।'
 

No comments

Powered by Blogger.