নেতারা যেন একে অপরের শত্রু by শাহজালাল রতন,

বিভক্তি, দলাদলিতে জর্জরিত ফেনী বিএনপি। গত কয়েক বছরে কোন্দলে দলের এমপিসহ অনেক নেতা স্থানীয় নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়েছেন। পরীক্ষিত অনেক নেতাই এখন রাজনীতি থেকে দূরে। দলীয় কর্মসূচিতে এমপিদের ফেনীর রাজনীতির মাঠে পাওয়া যায় না। অনেকে দল ছেড়ে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। গত সাধারণ নির্বাচনে ফেনীর তিনটি সংসদীয় আসনে বিএনপি জয়লাভ করলেও


তাদের কেউ এখন আর ফেনীতে থাকেন না। ফেনীর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেও তাদের এখন সংস্রব নেই। সেই সঙ্গে দলের মধ্যে নানা মতের নানা মানুষের কারণে আন্দোলন, মিছিল ও মিটিংয়ে অনেক নেতার দেখা পাওয়া যায় না।
বিরোধের শুরু
ভিপি জয়নাল বিএনপিতে যোগ দেন ১৯৯৬ সালের দিকে। যোগদানের পর তাকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মোশাররফ হোসেন ছিলেন সভাপতি। গত বিএনপি শাসনামলে ফেনী বিএনপিতে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এ সময় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ভাই মেজর (অব,) সাঈদ এস্কান্দারকে কেন্দ্র করে ফেনী বিএনপিতে বিরোধের সূত্রপাত। ফেনী বিএনপির একটি প্রভাবশালী অংশ দলের জেলা সভাপতি মোশাররফ হোসেন এমপি ও সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন ভিপির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। তারা সাঈদ এস্কান্দারকে জেলা সভাপতি করে কমিটি গঠনের চেষ্টা চালায়। এ গ্রুপটি ভিপি জয়নালকে বহিরাগত হিসেবে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। ভিপি জয়নালকে জাসদ বিএনপি হিসেবে প্রচার আরম্ভ করে। বিএনপির বর্তমান অনেক নেতার ভাষ্য, তেলে-পানিতে কখনও মেশে না। ভিপি জয়নালের সঙ্গে জাসদের একটি অংশ বিএনপিতে যোগদান করেছিল। মূল বিএনপি ও জাসদের সঙ্গে সম্পর্ক কখনও খাপ খায়নি। মূল বিএনপিকে পাশ কাটিয়ে তিনি দল চালাতেন বলে তাদের অভিযোগ।
বিএনপি রক্ষা কমিটি
ফেনী বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ভিপিবিরোধীরা তৎকালীন বিএনপিদলীয় পৌর মেয়র নূরুল আবসারকে প্রধান করে বিএনপি রক্ষা কমিটি গঠন করে। জাতীয় ও স্থানীয় বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে জেলা কমিটির পাশাপাশি রক্ষা কমিটির নামে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি গ্রহণ করা শুরু করে। ভিপিবিরোধীদের কর্মসূচিতে সাঈদ এস্কান্দার অংশগ্রহণ করেন। এ সময় দলের তৎকালীন কেন্দ্রীয় মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ফেনীতে জেলা বিএনপির এক সভায় অংশগ্রহণ করে আহ্বায়ক কমিটি করতে চাইলে ভিপি সমর্থকদের বিশৃঙ্খলার কারণে সভা পণ্ড হয়ে যায়। ভিপি সমর্থকদের অভিযোগ, মান্নান ভূঁইয়া সাঈদ এস্কান্দারকে জেলা কমিটির আহ্বায়ক করে কমিটি ঘোষণার পরিকল্পনা করেছিলেন।
মোশাররফ-ভিপিকে বাদ দিয়ে জেলা কমিটি
২০০৯ সালে জেলা বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই কাউন্সিল অধিবেশনে জেলা বিএনপির সভাপতি মোশাররফ ও সাধারণ সম্পাদক ভিপি জয়নাল অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। কাউন্সিল অধিবেশনে সাঈদ এস্কান্দারকে সভাপতি ও জিয়াউদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। সভায় ভিপি গ্রুপের কোনো নেতা উপস্থিত ছিলেন না। জেলা কমিটি ও থানা কমিটিতে তাদের স্থান হয়নি। ফলে দলের একটা বড় অংশ তখন থেকে দলের বাইরে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে অন্যতম দলের সহসভাপতি সামছুল হক দুতু, জেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক শেখ ফরিদ বাহার, সোনাগাজী থানা কমিটির সভাপতি জয়নাল আবেদিন বাবলু, সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দিন খোকন, পৌর বিএনপি সভাপতি আলাউদ্দিন গঠন। গত সাধারণ নির্বাচনে তারা সোনাগাজীতে এমপি প্রার্থী মোশাররফ হোসেনের পক্ষে কাজ করায় তাদের দলে স্থান দেওয়া হয়নি বলে জয়নাল আবেদিন বাবলু অভিযোগ করেন। এ ছাড়া দলে বিভাজনের কারণে সাংগঠনিক কাজ থেকে দূরে রয়েছেন সাবেক দাগনভূঞা থানা সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন প্রমুখ। ইতিমধ্যে দল ছেড়েছেন সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার, সাবেক যুবদল সেক্রেটারি জাহাঙ্গির চেয়ারম্যান প্রমুখ।
ফেনীতে অনুপস্থিত দলের এমপি
ফেনী জেলার ৩টি সংসদীয় আসনেই বিএনপি জয়লাভ করে। তারপরও কোনো এমপিকে এখন দলের কোনো সভায় দেখা যায় না। ফেনী-১ আসনের এমপি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় তার পক্ষে ফেনীর রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকা সম্ভব নয়। দলের নেতাকর্মীরাও তা আশা করেন না। বিএনপি নেতাকর্র্মীদের অভিযোগ, ফেনী-২ আসনের এমপি ভিপি জয়নাল ও ফেনী-৩ আসনের এমপি মোশাররফ হোসেনকে হরতাল কিংবা অন্য কোনো আন্দোলন সংগ্রামে দলের নেতাকর্মীরা পাশে পান না। তারা সমর্থকদের নিয়ে হরতালে একটা মিছিল করেছেন_ এমন নজির নেই বলে তাদের অভিযোগ।
এ ব্যাপারে ভিপি জয়নাল জানান, তিনি এখন ঢাকায় থাকেন, সেখানে তিনি নিয়মিতভাবে দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। মোশাররফ হোসেনের সর্মথকরা জানান, তিনি এখন খুবই অসুস্থ। আসতে পারেন না। দলের সাবেক এমপি জেলা কমিটির সভাপতি সাঈদ এস্কান্দার থাকেন ঢাকায়। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। তিনি বিশেষ কোনো দিবস ছাড়া বিএনপির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
যুবদল-ছাত্রদলে নানা বিভক্তি
জেলা ছাত্রদলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে। কাউন্সিলে সভাপতি করা হয় আমান উদ্দিন কাউসার সাবি্বর ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় নইম উল্লাহ বরাতকে। কাউন্সিলে নির্বাচিত ৭ সদস্যের কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সভাপতি আমান উদ্দিন কাউসারের পছন্দ নয় সেক্রেটারি বরাত। তাকে পরিবর্তনের দাবিতে সভাপতির সমর্থকরা মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। সৃষ্টি হয় বিরোধ। দু'পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে। ফলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গত দেড় বছরেও সম্ভব হয়নি। থানা, পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কোনো কমিটি আর এখন তৎপর নয়। সর্বশেষ দলীয় চেয়ারপারসন ছাত্রদল নেতাদের ঢাকায় ডেকে নিয়ে মিলেমিশে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
একই অবস্থা জেলা যুবদলের। গত রোজার সময় জেলা বিএনপির ইফতার মাহফিল ভণ্ডুল করে দেওয়ার জন্য জেলা যুবদলের সভাপতি গাজী মানিককে দায়ী করা হয়। ওই সভায় মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ইফতার না করেই সবাইকে স্থান ত্যাগ করতে হয়। পরে সভাপতি ও তার ৫ সমর্থককে বিএনপি থেকে নোটিশ দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
নেতৃত্ব নিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতা
দলের একাধিক প্রবীণ নেতা দাবি করেন, ফেনী বিএনপিতে নেতার শত্রু নেতা। বিভিন্ন উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধাচরণ প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেনী সদর উপজেলা নির্বাচনে দলের চেয়ারম্যান প্রার্থী সৈয়দ মিজানের বিরুদ্ধে দলের বেশ কিছু প্রথম শ্রেণীর নেতা প্রকাশ্যে অন্য প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নেন। ফেনী পৌর নির্বাচনে দলের প্রার্থী ফারুক হারুনের দলীয় মনোনয়ন পরিবর্তনের জন্য শেষ দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে লবিং চালিয়েছেন দলের অনেক নেতা। পরশুরাম পৌর নির্বাচনে আবু তালেব, দাগনভূঞায় আকবর হোসেন দলীয় নেতাদের বিরোধিতার কারণে পরাজিত হন বলে অভিযোগ করেন।
দলের একাধিক নেতার অভিযোগ, সব দলেই নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল থাকে কিন্তু ফেনীর কোন্দল ব্যক্তি পর্যায়ে শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। এ বিরোধ থেকে বের হয়ে ফেনীতে বিএনপির সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি করা এখন অনেকটা অসম্ভব।
ফেনী থেকে নির্বাচিত বিএনপিদলীয় এমপি জয়নাল আবেদীন ভিপি বলেছেন, জেলা বিএনপির রাজনীতিতে তিনি এখন নেই। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। জেলা বিএনপি যখন ডাক দেবে তখনই আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দেবেন। ফেনী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন ফেনী বিএনপির কোন্দলকে মামুলি ঘটনা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হলে মাঠেই ঐক্য সৃষ্টি হবে। গনমানুষ বিএনপির পক্ষে রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে ফেনীর মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে।

No comments

Powered by Blogger.