ওয়াল স্ট্রিট থেকে ওয়ার্ল্ড স্ট্রিটস শোষিতের জাগৃতি by মুহাম্মদ রুহুল আমীন

বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) শীর্ষ বৈঠকের আগে-পরে বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ, গত জুনে মাদ্রিদের সংক্ষুব্ধদের (Indignados) শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ, গত আগস্টে লন্ডনের অরাজকতাপূর্ণ বিদ্রোহ প্রভৃতি কেবল বিচ্ছিন্ন বিশ্ব সংবাদ হিসেবে পত্রিকার পাতায় লিপিবদ্ধ থাকে। কিন্তু সেই বিক্ষোভকারীদের বিনম্র বা বজ্রদাবির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছিল বিশ্বব্যাপী।


গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে মাসাধিককাল ধরে নিউ ইয়র্কের 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' বিক্ষোভটি পুঁজিবাদবিরোধী বৈশ্বিক আন্দোলনের সূত্রপাত করে। টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সংগঠিত এ আন্দোলন অতি দ্রুত ধূমায়িত আগ্নেয়গিরির মতো সড়ক, পার্ক, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ছড়িয়ে পড়ে। নিউজিল্যান্ড থেকে লন্ডন, ফ্রাংকফুর্ট, রোম, এথেন্স, মাদ্রিদ, ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, অটোয়া, টরন্টো হয়ে আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃত এ আন্দোলন এখন পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ শহরে প্রতিনিয়ত অগ্ন্যুৎপাত ঘটাচ্ছে। আন্দোলনকারীদের সংগঠন-কৌশল, কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ও দাবি-দাওয়ার প্রকৃতিগত বিশ্লেষণ থেকে অনুমিত হচ্ছে, তাঁরা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস চাচ্ছেন এবং তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এখনকার আন্দোলন-বিক্ষোভ বিভিন্ন মাত্রায় ও বিভিন্ন রূপে একটি প্রলম্বিত যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করবে।
বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ ও দাবি-দাওয়ার নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন এবং সেই নিরিখে বৃহৎ শক্তিবর্গের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত না হলে বর্তমানকালের বিশ্বব্যবস্থা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে এবং বিশ্ববাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন চরম অনিশ্চয়তা ও অরাজকতায় নিপতিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভকারীদের স্লোগানগুলো হলো : ১. দখল করো ওয়াল স্ট্রিট; ২. দখল করো ডিসি; ৩. ওয়াল স্ট্রিট লোভ ক্ষুধার্ত শিশুকুল; ৪. দখল করো ওয়াল স্ট্রিট, আফগানিস্তান নয়; ৫. আমরাই ৯৯%। তাদের দাবি-দাওয়ার সারমর্ম হলো, ধনী-দরিদ্রের বিশাল ব্যবধান, রাজনীতিতে করপোরেট ব্যবসা-বাণিজ্যের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রাধান্য, অসীম বেকারত্ব, দুরতিক্রম্য ব্যাংকঋণ, অসম করব্যবস্থা, ব্যাংকব্যবস্থার নানা লুক্কায়িত ফি, কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ব্যয়বহুল এশীয় মধ্যপ্রাচ্যীয় যুদ্ধ এবং সর্বোপরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
নিউ ইয়র্ক থেকে শুরু হওয়া পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তে ফোর্বস প্রকাশ করেছে ১০ জন সবচেয়ে ধনী নির্বাহী কর্মকর্তার নাম, যাঁদের আয়ের অঙ্ক আকাশছোঁয়া। যুক্তরাষ্ট্রের সেরা দশ ধনী নির্বাহী এক বছরে মোট যা আয় করেন, তা দিয়ে গড়ে ১৮ হাজার ৩৩০ জন মার্কিনির বেতন দেওয়া যায়।
উত্তর আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডার অটোয়া, ভ্যানকুভার, মন্ট্রিল, টরন্টোসহ বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভকালে নিম্নোক্ত দাবিগুলো পেশ করা হয়েছে : ১. পুঁজিবাদ বন্ধ করো; ২. টরন্টো স্টক এঙ্চেঞ্জ দখল করো; ৩. বৈষম্য দূর করো।
ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে যে বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন করছে, তাদের দাবিগুলো হলো : ১. লন্ডন স্টক এঙ্চেঞ্জ দখল করো; ২. ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিবর্তন করো; ৩. ট্যাক্স সিস্টেম সংস্কার করো; ৪. পুঁজিবাদ হটাও।
নভেম্বরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তম শহর সিডনিতে বিক্ষোভরত আন্দোলনকারীদের মিছিলে উচ্চারিত হয়েছে : ১. সিডনি দখল করো; ২. পুঁজিবাদ বন্ধ করো; ৩. ব্যবধান হ্রাস করো; ৪. আমাদের অর্থ খেয়ে ফেলো না; ৫. নির্যাতন থামাও।
এভাবে পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন গত সেপ্টেম্বরের মাঝপথে ওয়াল স্ট্রিট থেকে শুরু হলে প্রথমে কেউই বুঝতে পারেনি, এ বিক্ষোভ একসময় পুঁঁজিবাদবিরোধী বৈশ্বিক বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করবে। উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়ে দেখতে দেখতে এক মাসের মধ্যে ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ চারটি মহাদেশে এর লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। নিউ ইয়র্ক, অটোয়া, টরন্টো, ভ্যানকুভার, লন্ডন, মাদ্রিদ, প্যারিস, শিকাগো, জুরিখ, ডাবলিন, টোকিও, হংকং, সিউল, তাইপে, মেলবোর্ন, সিডনি, আমস্টারডাম, ফ্লোরেন্স প্রভৃতি পুঁজিবাদী শহরের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রগুলো পুঁজিবাদবিরোধী বিদ্রোহের আন্দোলনের সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে।
ওয়াল স্ট্রিট থেকে শুরু হয়ে পৃথিবীর সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়া পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠায় পুঁজিবাদের বিকল্প ব্যবস্থা প্রণয়ন। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে পুঁঁজিবাদ চরম ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ ইউরোপের সামন্তবাদ, বণিকবাদ (merchantitism), ক্লাসিক্যাল পুঁজিবাদ এবং অধুনা প্রচলিত সম্ভ্রান্ত নব্য উদারবাদী পুঁজিবাদ (no-liberal capitalism)_এসব মতাদর্শ পৃথিবীর মানুষের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার প্রয়োজনীয় সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
পুঁজিবাদের উপরোক্ত ব্যর্থতার কারণ হলো_পুঁঁজিবাদের অন্তর্নিহিত কাঠামোগত ত্রুটি এবং এ কারণে এ মতাদর্শের বাস্তবায়নের প্রায়োগিক প্রতিবন্ধকতা। ফলে যে ইস্যুগুলো সৃষ্টি হয়েছে তা হলো : ১. ত্রুটিপূর্ণ ব্যাংকব্যবস্থা; ২. অসম করব্যবস্থা; ৩. অর্থনৈতিক বৈষম্য; ৪. রাজনৈতিক অনাচার; ৫. সামাজিক অবিচার; ৬. ৯৯:০১ সমাজ বিন্যাস; ৭. শ্বাসরুদ্ধকর অসম জীবনমান।
বস্তুত এ ইস্যুগুলো এখন পুঁজিবাদী, আধা পুঁজিবাদী বা মিশ্র-অর্থনীতির দেশগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক সমাজচিত্র। যেহেতু বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুঁজিবাদের নীতি-আদর্শের ছাঁচে সমাজব্যবস্থা নির্ণীত হচ্ছে, তাই সর্বত্রই একই রকমের, একই প্রকৃতির, একই মাত্রার বৈষম্যমূলক সমাজ-কাঠামো বিদ্যমান। এই সহজ সত্যের স্বীকৃতি তাই প্রত্যেক বিশ্ব নেতার কাছে সমানভাবে উচ্চারিত হচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মনে করেন, সাম্প্রতিককালের আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থার প্রতি আমেরিকানদের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকার ব্যাংক বিষয়ে তিনি মনে করেন, লুক্কায়িত ফির ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকব্যবস্থা চলতে পারে না। ওবামার এ পর্যবেক্ষণ সঠিক বলে বিবেচিত হয়।
বিশ্বায়নের বদৌলতে পুঁজিবাদের ব্যর্থতার বিশ্বময় স্বীকৃতি একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের কাছে স্পষ্ট হলেও পুঁজিবাদের ব্যর্থতার কাহিনী গত শতাব্দীগুলোতেও কারো অজানা ছিল না। সমকালীন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্তি্বক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল মার্কস তাঁর 'ডাস ক্যাপিটাল' বা 'পুঁজি' শীর্ষক গ্রন্থে পুঁজিবাদের শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের প্রকৃতি ও পরিধি ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসীয় চিন্তাধারার অনুসারীরা পরবর্তীকালে 'কেন্দ্র-প্রান্ত তত্ত্ব', 'নির্ভরশীলতা তত্ত্ব', 'কাঠামো-বিন্যাস তত্ত্ব' প্রভৃতি ধারার মার্কসীয় তত্ত্বের প্রবর্তন করেন।
মার্কসীয় তত্ত্ব শুধু পুঁথি-পুস্তকে লিপিবদ্ধ থাকেনি। এর ওপর ভিত্তি করে ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের সিঁড়ি বেয়ে বলশেভিকরা গড়ে তোলে বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত শতাব্দীর আশির দশকে সেই দেশটি মার্কসীয় রাষ্ট্র হিসেবে আর টিকে থাকতে সক্ষম হয়নি। মার্কসীয় সমাজবাদের পতনের পর উল্লসিত পুঁজিবাদীরা 'ইতিহাসের অবসান' (end of history) তত্ত্বের প্রচার করতে থাকে এবং পুঁজিবাদের বিশ্ব জয়ের ঘোষণা প্রচারিত হতে থাকে।
২০ বছর আগে শুরু হওয়া এক মেরু বিশ্বব্যবস্থায় এভাবে বিশ্বজয়ী মতাদর্শ হিসেবে পুঁজিবাদের দ্বিতীয় অগ্রযাত্রা শুরু হলেও সেই আগমনী বার্তা বেশি দিন সুবাতাস বয়ে দিতে পারেনি। পুঁজিবাদবিরোধী মনোভাব বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রকৃতির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাতে গতি সঞ্চার করে এবং সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে পরিপূর্ণ একটি দিকনির্দেশনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন ঈপ্সিত লক্ষ্য বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এমনিতেই স্তব্ধ হয়ে যাবে বা রাষ্ট্রিক অত্যাচারের স্টিমরোলার দিয়ে তা গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে। ওয়াল স্ট্রিট ক্ষুদ্র পরিসর থেকে এ আন্দোলন শুরু হয়ে অল্প কদিনেই 'দখল করো' (অকুপাই) চেতনা ধারণ করে। অর্থাৎ এত দিন পৃথিবীময় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা পুঁজিবাদী আদর্শ বৈষম্যের যে বিশাল স্থাপনা তৈরি করেছে, তা আজ 'দখল করো' চেতনায় পর্যবসিত হতে চলেছে।
অকুপাই আন্দোলনের 'দখল করো চেতনার মধ্যে হয়তো সেই উত্তরের বীজও নিহিত আছে। অকুপাই আন্দোলনের একজন প্রথম সারির উদ্যোক্তা কেভিন জেসের মতে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবোধই তাদের রাস্তায় নামিয়েছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনীতে অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা যেমন যুদ্ধটাকে মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিল, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতাও তেমনি মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থাকে ব্যক্তির পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে।' ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-দখল নীতির পরাজয় নিশ্চিত হয়েছিল। মার্কিনিদের দ্বারা পরিচালিত, মার্কিনিদের অংশগ্রহণে সঞ্চারিত এবং মার্কিন মুলুকে অঙ্কুরিত বিদ্রোহের বীজ মহীরুহের রূপ ধারণ করে যেভাবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে তার শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে, তাতে স্পষ্টতই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিশ্চিত মৃত্যু-আর্তি ও নির্যাতিত মানবতার সরব জাগৃতি ঘোষিত হচ্ছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
john-nirjhar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.