ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা-চামড়া না কেনার খেসারত দেবেন ট্যানারি মালিকরা by ফারজানা লাবনী

ন্তর্জাতিক বাজারে মন্দার দোহাই দিয়ে ট্যানারির মালিকদের সময়ক্ষেপণের কারণে চামড়ার মান নষ্ট হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে চামড়ার রপ্তানি বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর দাম বেশি থাকায় পার্শ্ববর্তী দেশে চামড়া পাচার অব্যাহত থাকলে প্রয়োজনীয় কাঁচা চামড়ার জোগান পেতে সমস্যায় পড়বেন ট্যানারির মালিকরা।ঈদের পর ১২ দিন পার হয়ে গেলেও ট্যানারির মালিকরা চামড়া কিনতে গড়িমসি করতে থাকায় এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এ শিল্পের সংশ্লিষ্টরা।


ট্যানারির মালিকরা গতকাল পর্যন্ত চামড়া কিনেছেন ১০ লাখেরও কম। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে পড়ে রয়েছে প্রায় ২৪ লাখ কোরবানির পশুর চামড়া। তাঁদের অভিযোগ, পরে কম দামে চামড়া বেচতে বাধ্য করার জন্যই ট্যানারির মালিকরা সময় নিচ্ছেন। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে তত দিনে চামড়ার মান নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করে তাঁরা বলেন, এতে দেশেরই ক্ষতি হবে। কারণ মান কমে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের দামও কমে যাবে। উন্নত মানের চামড়ার উৎস হিসেবে বাংলাদেশের সুনামও ক্ষুণ্ন হবে। যার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব রপ্তানিকারকদেরই ভোগ করতে হবে।
এদিকে ট্যানারির মালিকরা জানান, চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার মন্দা। গত বছরের চামড়াও তাঁদের গুদামে পড়ে রয়েছে। নতুন করে চামড়া কিনলে তা রাখার জায়গা তাঁদের নেই।
চামড়া সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে চামড়া কিনে দুই থেকে চার সপ্তাহ রেখে তা বিক্রি করেন। শুধু লবণ মাখিয়ে চামড়া বেশি দিন রাখা যায় না। এ পরিস্থিতিতে দরকষাকষির একপর্যায়ে তাঁদের কম দামে ট্যানারির মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করে দিতে হয়। সে সুযোগের জন্যই ট্যানারির মালিকরা ওঁৎ পেতে রয়েছেন বলে অভিযোগ করেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দার দোহাই দিয়ে ট্যানারির মালিকদের সময়ক্ষেপণ করে দাম কমানোর একটি কৌশল বলে মনে করছেন কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। চামড়া ব্যবসায় জড়িত একাধিক সংগঠনের সঙ্গে আলাপ করে এবারের কোরবানি পশুর চামড়া বাণিজ্যের এ চিত্র পাওয়া গেছে।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি, লেদার ইঞ্জিনিয়ারস্ অ্যান্ড টেনোলজিস্টস্ সোসাইটি, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মাচেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ঈদেরও সপ্তাহখাসেক পর অর্থাৎ গত রবিবার (১৩ নভেম্বর) থেকে চামড়া কেনা শুরু করেছেন ট্যানারির মালিকরা। সেদিন থেকে দেশের প্রায় সব জায়গায় দরকষাকষি করে চামড়া বিক্রি হয়েছে। ট্যানারির মালিকরা প্রতি বর্গফুট চামড়া ৬৮ থেকে ৭৫ টাকার বেশি দামে কিনছেন না। আবার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা ৮৫ থেকে ৮৭ টাকার কমে চামড়া বিক্রিতে রাজি নন। তাঁদের যুক্তি, প্রতিবেশী দেশের ব্যবসায়ীরা ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় এ দেশের কোরবানির পশুর চামড়া কিনছেন। সে জন্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেশি দামে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাঁদের চামড়া সংগ্রহ করতে হয়েছে। ট্যানারির মালিকরা যে দাম দিতে চাচ্ছেন, সে দামে বিক্রি করলে বিপুল লোকসান হবে বলে চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান। প্রতিবেশী দেশের ব্যবসায়ীরা বেশি দাম দেওয়ায় ইতিমধ্যেই সীমান্ত পথে প্রায় ছয় লাখ কাঁচা চামড়া পাচার হয়েছে বলে দাবি করেন তাঁরা।
লেদার ইঞ্জিনিয়ারস্ অ্যান্ড টেকনোলজিস্টস্ সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক সঞ্জয় ঠাকুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্যানারিগুলো সারা বছরের চামড়া সংগ্রহ করে ঈদুল আজহার সময়। চলতি বছর লোকসান এড়িয়ে চামড়া কিনছেন মালিকরা। ফলে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া থেকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এ দেশে চামড়া সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি না থাকায় প্রতিদিনই চামড়ার গুণগত মান কমছে। ফলে বিশ্ববাজারে এ দেশের চামড়ার কদর কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এ দেশের চামড়া শিল্প। এ ছাড়া দাম কম থাকায় সীমান্ত পথে চামড়া বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চামড়া পাচার হতে থাকলে এ দেশে চামড়ার সংকট হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
একই মত প্রকাশ করে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ভালো দাম না পেলে আরো চামড়া পাচার হয়ে যাবে। খুলনার শাহপুর এলাকার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ঈদের পর থেকে ভারতে চামড়া পাচার হচ্ছে। আগে বর্ডারের কাছাকাছি জায়গা থেকে চামড়া পাচার হয়েছে। এখন দূর থেকে আসা চামড়াও যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার এক কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী জানান, আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে ট্যানারির মালিকরা দাম কমানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা জানেন চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা বেশি দিন ধরে রাখতে পারবেন না। দাম কমাতে বাধ্য হবেনই। এভাবে ট্যানারির মালিকরা কৌশলে কম দামে চামড়া কিনতে চাচ্ছেন!
ওই ব্যবসায়ী আরো বলেন, এ পরিস্থিতির সুযোগে প্রতিবেশী দেশের ব্যবসায়ীরা দাম সামান্য বেশি দিয়ে হলেও এ দেশের কোরবানির পশুর চামড়া কিনছেন। তাঁদের দেশে চামড়া সংরক্ষণের উন্নত ব্যবস্থা আছে। তাই চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকছে না। আবার তাঁদের লোকসানের ভয়ও নেই, কারণ এ দেশের চামড়ার গুণগত মান ভালো হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দামও ভালো পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মাচেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আফতাব খান জানান, চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দা থাকলেও এ দেশের চামড়ার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ট্যানারস্ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববাজারে দাম পড়তি থাকায় কোনো অবস্থায় ৭০ থেকে ৭৫ টাকার বেশি দামে চামড়া কেনা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। বিভিন্নভাবে ট্যানারির মালিকরা সব শ্রেণীর চামড়া ব্যবসায়ীর কাছে বিষয়টি জানিয়েছেন। আমেরিকায় কাঁচা চামড়ার দাম গতকাল ২০ ডলার কমেছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।
তিনি বলেন, গত বছর অ্যানথ্রাঙ্ আতঙ্কে স্থানীয় বাজারে চামড়ার স্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে স্থানীয় বাজার থেকে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কিনে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এতে আমাদের নির্ধারিত বায়াররা চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারত, ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশ থেকে চামড়া কিনেছেন। এ কারণে চলতি বছর ট্যানারির মালিকরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেমন অর্ডারও পাননি বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.