ইনি কোন ভূবনের অলি? by ফজলুল বারী

শ্লীল-অশ্লীল বলে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ আছে বাংলা সাহিত্যে। এ ধরনের শব্দ শুধু বাংলা সাহিত্যে থাকার কথা ক্যাটাগরিকেলি বললে অবশ্য ভুল বলা হবে। পৃথিবীর তাবৎ সভ্য দেশ-জাতির ভাষাভাষি মানুষের জীবন সাহিত্যেও এর উপস্থিতি। অসভ্যদের বিষয় আলাদা। একটি সভ্য সমাজের বাসিন্দারা তাদের অনুসারী নেতানেত্রীর কাছে এর চর্চা আশা করেন। অসভ্যদের বিষয় আলাদা। তাদের কাছে আশা করার কিছু নেই।

আমেরিকার মতো দেশেও নাগরিকরা চান তাদের নেতাটি হবেন ফুলের মতো পবিত্র। বিল ক্লিনটন-মনিকা স্ক্যান্ডাল নিয়ে সে কারণে সেদেশটায় এত হৈচৈ হয়েছে! এলডিপির প্রধান কর্নেল (অব) অলি আহমেদের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যের পর নারীকে আক্রমন অথবা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতার শ্লীল-অশ্লীনজ্ঞানের বিষয়টি এখন বাংলাদেশের সামনে! জাতীয় সংসদেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মিডিয়ার খবর অনুসারে অলি আহমেদ বিতর্কিত মন্তব্যটি করেছেন চট্টগ্রামের এক সভায়। সংরক্ষিত মহিলা আসনের এক এমপি সম্পর্কে তিনি সেই সভায় বলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকায় একজন সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে অনেক যুবক আছে। একজন মাত্র মহিলা এমপি দিয়ে কী হবে? ফরিদপুর থেকে কিছু সুন্দরী মেয়ে দিলে যুবকদেরও কাজে লাগত।’

বলাবাহুল্য সম্ভবত সরকারি কোন একটি কাজে হতাশা থেকে তিনি এমন একটি কান্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য করে থাকতে পারেন। একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন নির্বাচিত এমপি বিরোধীদলের হওয়াতে সেখানে সংরক্ষিত আসনের সরকারদলীয় মহিলা এমপিকে কেন উন্নয়নের একতরফা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে জবাব সরকারকে দিতে হবে। যেমন কর্নেল অলিকে নিতে হবে এধরনের কদর্য মন্তব্যের দায়দায়িত্ব! মুসলমানদের ধর্মীয় বিবেচনায় অলি-দরবেশ এসব ভক্তি-শ্রদ্ধার টার্ম। অলি-দরবেশদের লোকজন শ্রদ্ধা-ভক্তিতে মান্যিগন্যি করেন। আবার পীর-অলি নামধারী কপট-ভণ্ড লোকজনও হামেশা ধরা পড়ে। এই অলি কোন ভূবনের সে প্রশ্নও এখন আরও সামনে আসবে।

আজকালের জমানায় রাজনীতিতে নানা কাজে আনন্দিত অথবা হতাশ হতে পারেন কর্নেল অলি আহমেদ। দৃশ্যত বেশ কিছুদিন ধরে অবশ্য তার অনেক হতাশা লুকোছাপা নেই। ১৯৯১-৯৬’র বিএনপি জমানায় তিনি যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তার নির্বাচনী এলাকায় জামায়াতের সঙ্গে বেয়াদবির(!) কারনে ২০০১-২০০৬ জমানায় তাকে আর মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। অতঃপর অলস সময়কে কাজে লাগাতে তিনি পড়াশুনা করেন। অর্জন করেন ডক্টরেট ডিগ্রী । পরবর্তিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো গড়েন আলাদা দল। অধ্যাপিকা জাহানারা বেগমের মতো বিশেষ কারণে আলোচিত সাবেক বিএনপির মহিলানেত্রী দেখে একজনকে দলের মহাসচিবও করেন। মহাজোটেও আসেন ১/১১’র আগে। কিন্তু গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একতরফা রেজাল্ট করে ফেলাতে মহাজোটের শরীক অনেক দল-নেতার মতো তারও আর দরকষাকষির মূল্য হয়নি! অলিদের কাছে মূল্যায়ন মানেতো মন্ত্রিত্ব!

এরমাঝে আবার তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দোকান অথবা দল এলডিপির কোন গণভিত্তি না হওয়াতে অধ্যাপক চৌধুরীর মতো তিনিও আবার বিএনপির ছায়ায় ফেরার মনস্থির করেছেন। সরকারি নানা ব্যর্থতা উল্লেখ করে সংসদীয় সরকারটি ‘আগামি বাজেট পর্যন্ত টিকবেনা’, ‘আল্লাহপাক এই সরকারের পতন কবুল করে ফেলেছেন’ জাতীয় ফতোয়াও দিয়েছেন! যেখানে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ বা দলকানারা সব পারেন, খালেদা জিয়া সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দেবার পর এককাঠি সরেস মাপে তা ডাস্টবিনে ফেলে দেবার শপথ করেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী! তা আদালত বিবেচনায় নিতে গেলে উল্টো আদালতে হাতাহাতি, বিচারককে ট্রে পর্যন্ত ছুঁড়ে মারেন একদল দলকানা আইনজীবী! এরপর তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ গঠন করে ফেলে পরিস্থিতি শান্ত করার নামে তাতে ক্ষান্তও দেওয়া হয়!

সেখানে মুক্তিযোদ্ধা অলি আহমদ যেহেতু খালেদা জিয়ার কাছে ফেরত যাবার উদ্দেশে এখন আর তেল-পানি তথা রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধায় কোন ভেদাভেদ দেখছেন না, সেখানে সংসদের মেয়াদ শেষ হবার আগেই সরকারের পতন আল্লাহপাক কবুল করে ফেলেছেন বলে খালেদা জিয়াকে খুশি করার চেষ্টাই করতে পারেন!

তা প্রশ্ন উঠতে পারে ‘ফরিদপুরের সুন্দরী নারী কামনার’ তার সর্বশেষ বচন অথবা বাসনাটি খালেদা জিয়াকে খুশি করবে কী? কর্নেল (অব) ভাবতে পারেন, তিনিতো আর ফেনী, দিনাজপুর, বা বগুড়ার সুন্দরী নারী চাননি, তাই এ ধরনের মন্তব্যে তার প্রতি মাইন্ড না করে উল্টো খুশি হতে পারেন খালেদা জিয়া! সত্যি কী তাই? খালেদা জিয়াতো বাংলাদেশের কোন অঞ্চলের নেত্রী না। জাতীয় নেত্রী। অলি’র এই কদর্য মন্তব্যতো শুধু ফরিদপুরের নারী না, বাংলাদেশের নারীর মর্যাদার বিরুদ্ধে সরাসরি অশ্লীল এক আক্রমন! যেখানে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে, বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে নারী তার নিজস্ব যোগ্যতায়-সংগ্রামে নিজের জায়গাটি করে নিয়েছে অথবা সংগ্রাম করে যাচ্ছে, সেখানে অলি’র মতো বান্দা তাদের ভোগের সামগ্রী করার যে মনোবাসনা প্রকাশ করেছেন তাতে বেজার না খুশি হয়েছেন খালেদা জিয়া? কদর্য বক্তব্যটির জন্য অলি যদি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা, দূঃখপ্রকাশ না করেন, মাপ না চান, তাহলে প্রশ্নটি  খালেদা জিয়া পর্যন্ত গড়িয়ে পড়তে পারে!

পুরুষতান্ত্রিক বাংলাদেশের সমাজে রাজনীতিতে নারীকে ভোগবাদী চিন্তায় আক্রমন অবশ্য নতুন না। শাহ মোয়াজ্জেমের এমন কথাবার্তা দেশের মানুষ অবশ্য ভুলে যাননি। স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন করার সময় শাহ মোয়াজ্জেমের সেই আলোচিত ঘৃণ্য মন্তব্যটি ছিল, ‘দুই মহিলার মিলনে কিছু হয়না!’ ১৯৯১-৯৬ জমানায় এরশাদ যখন জেলে তখন তার কারাসেলে সিসিটিভি লাগানোকে কেন্দ্র করে শাহ মোয়াজ্জেম খালেদা জিয়াকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘আমাদের স্যারের টয়লেটেও নাকি সিসিটিভি, তার সবকিছু দেখার এত আগ্রহ কেন!’

এরশাদ যখন মহাজোটের দিকে ঝোঁকেন তখন জেল হত্যা মামলায় খালাশপ্রাপ্ত রাজনৈতিকভাবে এতিম হয়ে পড়া সেই শাহ মোয়াজ্জেমকে অতঃপর  খালেদা জিয়ার ছায়াতলেই আশ্রয় নিতে হয়েছে! আর তার ছায়াতলে আশ্রয় নেয়াতে কবে তিনি কোথায় তাকে কী বলেছিলেন, তাও আর মনে রাখার চেষ্টা করেননি খালেদা জিয়া! 

কিন্তু এমন শ্লীল-অশ্লীল জ্ঞান বিবর্জিত রাজনীতিকদের পরিণতি কী হয়? একদার মহাদাপুটে(!) সেই শাহ মোয়াজ্জেম এখন আর জীবিত আছেন কীনা, সে সাড়াশব্দ কী পাওয়া যায়? কর্নেল অলির গতিও কী সে পথে? না তিনি প্রমান দিলেন পড়াশুনা ঠিকমতো না হলেও হয়ত ডক্টরেট অর্জন করা গেলেও প্রকৃত ভদ্র-সভ্য হওয়া যায়না!

অলির বিষয়টি অনেকদূর গড়াবে আমাদের সমাজে-রাজনীতিতে। ক্ষমা চাইলেও। কারন এমনকিছু স্পর্শকাতর বক্তব্য-মন্তব্য সমাজে-রাজনীতিতে এমন দাগ দিয়ে রাখে যে তা সহজে মুছে যায় না। বাংলাদেশের সভ্য-অসভ্য জ্ঞানসম্পন্ন বাংলাদেশের নারীরাও তাকে ছেড়ে দেবেনা কোনদিন।

No comments

Powered by Blogger.