পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকের মুনাফা ২৭ শ কোটি টাকা by মজুমদার বাবু

পুঁজিবাজার থেকে ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো পরিচালন মুনাফা করেছে দুই হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ব্যাংকগুলো এ মুনাফার প্রায় পুরোটাই 'রিটেন আর্নিং' হিসেবে রেখে দিয়েছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজার থেকে কী পরিমাণ অর্থ বেরিয়েছে, এর কোনো হিসাব না পাওয়া গেলেও মার্কেট ক্যাপিটাল ৭০ হাজার কোটি টাকা কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতে তারল্য বাড়ানো (সিআরআর কমানোর মাধ্যমে), মার্চেন্ট ব্যাংককে দেওয়া ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফসহ নানা দাবি করে আসছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতীও হতে পারে। পুঁজিবাজার থেকে আসা ব্যাংকের মুনাফাকে রিটেন আর্নিং হিসেবে রেখে দেওয়ার কারণ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষ্য_অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বছর হিসেবে চলতি বছর ব্যাংকগুলোর মুনাফার প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে আসতে পারে। তাই ভবিষ্যতে এ রিটেন আর্নিং ভেঙে ব্যাংকগুলো তাদের শেয়ারহোল্ডারদের বিদায়ী বছরগুলোর প্রায় সমপরিমাণ ডিভিডেন্ড দিতে পারবে। এতে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও ঠিক থাকবে।
পরিচালন মুনাফা বলতে কর দেওয়া ও প্রভিশন রাখার আগে ব্যাংকের মুনাফাকে বোঝায়। এর মুনাফার ওপর ব্যাংকগুলোকে ৪২.৫ শতাংশ কর দিতে হয় এবং বিভিন্ন খাতের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ (প্রভিশন) রাখতে হয়। কর প্রদান ও প্রভিশন সংরক্ষণের পর ব্যাংকের হাতে থাকা মুনাফাকে নিট মুনাফা বলা হয়। ব্যাংকগুলো সাধারণত নিট মুনাফার ওপর ভিত্তি করেই লভ্যাংশ ঘোষণা করে থাকে।
সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ছিল ১৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা। প্রভিশন সংরক্ষণ ও কর পরিশোধ শেষে নিট মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ৩৫৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে মাত্র দুই হাজার ৭৩৭ কোটি এক লাখ টাকা এসেছে পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক ব্যবসা থেকে। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতের মোট পরিচালন মুনাফার ১৫.৯৮ শতাংশ মুনাফা এসেছে পুঁজিবাজার থেকে। পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক পরিচালন মুনাফার মধ্যে ব্যাংকগুলো শেয়ার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে মুনাফা করেছে দুই হাজার ৫০৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা এবং ধারণকৃত শেয়ারের লভ্যাংশ হিসেবে মুনাফা করেছে ২৩২ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
পুঁজিবাজার থেকে ৩০০ কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে দুটি ব্যাংক। এর মধ্যে এবি ব্যাংক ৩৮৭ কোটি পাঁচ লাখ টাকা এবং ন্যাশনাল ব্যাংক ৩৬৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। ২০০ কোটি থেকে ৩০০ কোটি টাকার মাঝখানে পরিচালন মুনাফা করেছে দুটি ব্যাংক। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক ২৪৯ কোটি দুই লাখ টাকা এবং সাউথইস্ট ব্যাংক ২২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। ১০০ কোটি থেকে ২০০ কোটি টাকার মধ্যে পরিচালন মুনাফা করেছে পাঁচটি ব্যাংক। এর মধ্যে দ্য সিটি ব্যাংক ১২১ কোটি ২২ লাখ টাকা, পূবালী ব্যাংক ১৫৯ দশমিক ৩৩ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ১৩৩ কোটি দুই লাখ টাকা, এক্সিম ব্যাংক ১৩০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ও প্রিমিয়ার ব্যাংক ১২৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। ৫০ কোটি ও ১০০ কোটি টাকার মধ্যে মুনাফা করেছে পাঁচটি ব্যাংক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ৮২ কোটি ২৬ লাখ, ইউসিবিএল ৯৫ কোটি ৭৩ লাখ, উত্তরা ব্যাংক ৫৩ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৫৫ কোটি ৩০ লাখ, ব্র্যাক ব্যাংক ৮৮ কোটি ৬৬ লাখ ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। পুুঁজিবাজার থেকে বাকি ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা ৫০ কোটি টাকার নিচে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একটি সূত্রে জানা যায়, পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকগুলো বিপুল মুনাফা করেছে। প্রকৃতপক্ষে তা নয়, পুঁজিবাজার থেকে ব্যাংকগুলোর সামষ্টিক মুনাফা অনেক একক ব্যক্তির মুনাফার তুলনায়ও অনেক কম। এখনো ব্যাংকগুলো হাজার কোটি টাকার বেশি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে রেখেছে। তা ছাড়া আমরা ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি, তাদের পুঁজিবাজার থেকে যে মুনাফা হয়েছে তার সম্পূর্ণ লভ্যাংশ আকারে বিতরণ না করে রিটেন আর্নিং হিসেবে সঞ্চয় করতে। কারণ চলতি বছরকে আমরা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বছর হিসেবে দেখছি। বাইরের বিশ্বে যখন একের পর এক ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো মুনাফা না করলেও অন্ততপক্ষে লোকসান করবে না। চলতি বছর ব্যাংকিং খাতের মুনাফার প্রবৃদ্ধি যদি কমেও, এর পরও ব্যাংকগুলো তাদের শেয়ারহোল্ডারদের এবং আমানতকারীদের আস্থা ধরে রাখতে তাদের রিটেন আর্নিং থেকে বিগত সময়ের কাছাকাছি লভ্যাংশ দিতে পারবে। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারেও ব্যাংকের শেয়ারের দর খুব একটা কমবে না। এতে করে বাজারের স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, ব্যাংকের সিআরআর কমানো হলে বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়বে এবং বাজার চাঙ্গা হবে। কিন্তু এ দাবির সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান খোন্দকার খালেদ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, 'সিআরআর-এসএলআর ইত্যাদি ব্যাংকিং ইস্যু। যাঁরা দাবি করছেন তাঁরা ব্যবসায়ী বা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। নিজেদের স্বার্থে এমন দাবি তাঁরা করতেই পারেন। কিন্তু যাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁদের ভাবতে হবে পুঁজিবাজার এমনিতেই অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। এরপর যদি ব্যাংকিং খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিও ধসে পড়বে।' তিনি আরো বলেন, প্রয়োজন হলে আইনি সীমার মধ্যে থেকে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ বাড়তে পারে। এতে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু সিআরআর-এসএলআর দেশের মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা-ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করতে তা বাড়ানো কিংবা কমানোর দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, পুঁজিবাজারের ধসের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর যোগসূত্র খুবই কম। এ দায়টা ব্যাংকের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে মূলত কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা কষ্টকর কিংবা জড়িতদের আড়াল করতে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট সিআরআর কিংবা এসএলআর বাড়ানোর কারণে সৃষ্টি হয়নি। এটা হয়েছে ব্যাংকগুলোর 'এগ্রেসিভ' ল্যান্ডিংয়ের কারণে এবং ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার কারণে। তিনি আরো বলেন, সিআরআর-এসএলআর বাড়ানো-কমানো এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং এটা বাড়ানো কিংবা কমানো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত 'সুনিয়ন্ত্রিত' হওয়ার কারণে এরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে_এমন ঘোষণায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আস্থা পায় বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ। এ কারণেই ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্যের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
পুঁজিবাজারে আসার পরামর্শ ইসলামী ব্যাংকগুলোকে

No comments

Powered by Blogger.