প্রকৃত অপরাধীরা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে?-লোকমান হত্যাকাণ্ড by আবু সাঈদ খান

দেশবাসীর দৃষ্টি এখন নরসিংদীর দিকে। সংবাদপত্র হাতে নিয়ে কিংবা টেলিভিশন সেটের সামনে বসে নাগরিকরা সর্বাগ্রে জানতে চাইছে_ নরসিংদী পৌরসভার মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের কী হলো? এর আগে মাসজুড়ে সবার দৃষ্টি ছিল নারায়ণগঞ্জের দিকে নিবদ্ধ। সেখানে অনুষ্ঠিত হলো সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। প্রেক্ষাপট আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু ঘটনা দুটির মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। সেটি জনগণের সন্ত্রাসবিরোধী মনোভাব।


নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জনগণ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে বিজয়ী করেছে। আর নরসিংদীতে জনগণ খুনি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছে।
সন্ত্রাস এখন রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি। রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্ত্রাস অতীতেও ছিল, তবে তা এত ব্যাপক ও ভয়াবহ মাত্রায় ছিল না। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের পোষ্য গুণ্ডারা বা এনএসএফের পাণ্ডারা বিরোধী পক্ষের জনসভা ভণ্ডুল, অনুষ্ঠানে ডিম ছোড়া, ক্যান্টিনে খেয়ে বিল না দেওয়া, কোমরে চাকু নিয়ে ঘোরাফেরা করে প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত থাকত। তখন নেতাকর্মী ও পাণ্ডাদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন ছিল। কিন্তু হাল আমলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতা আর সন্ত্রাসীদের মধ্যে পার্থক্য যেন ঘুচে গেছে। সন্ত্রাসীরা এখন ক্যাডার নামে অভিহিত আর গডফাদাররা নেতা নামে! এর মানে এই নয় যে, রাজনৈতিক দলে ত্যাগী নেতাকর্মী নেই। অবশ্যই আছেন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ যেমন জনমনে আছে, তেমন ক্ষোভ সৎ, ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীরাও অন্তরে লালন করেন। তবে সন্ত্রাসী, দুর্জনদের দৌরাত্ম্যে সৎ, মেধাবীরা সদা তটস্থ। অনেক ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসীদের হাতে সৎ ও মেধাবীরা নিগৃহীত-লাঞ্ছিত। এমনকি কোথাও কোথাও তাদের জীবনও দিতে হচ্ছে। এখন নতুন করে রাজনৈতিক দলের ভেতরে-বাইরে সন্ত্রাসী_ অস্ত্রবাজদের শক্তির মহড়া হচ্ছে, রাজনৈতিক অঙ্গন হচ্ছে রক্তাক্ত।
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে; মতপার্থক্য ও স্বার্থের দ্বন্দ্বও থাকতে পারে। তবে তা হবে মেধা ও যোগ্যতাকে হাতিয়ার করে। কিন্তু এর বদলে অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের মহড়া চলছে। রাজনীতিতে এখন মেধা ও মনন, জনমুখী কর্মসূচি ও সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তার চেয়ে অস্ত্র, অর্থ ও পেশিশক্তির মূল্যমান বেশি। রাজনৈতিক দলের বাইরেও সন্ত্রাসীরা রয়েছে। তারা রয়েছে প্রভাবশালী মহলের প্রশ্রয়ে। ঠিকাদারি, দখলবাজিতে তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ লক্ষণীয়।
এই যখন সন্ত্রাসকবলিত সমাজের চিত্র, তখন নরসিংদী এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। বরং সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে স্পষ্ট হলো, সেখানে তা প্রকট। সেখানকার তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি, জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হলেন। শুরু থেকেই সন্দেহের তীর দলের দিকেই। দলীয় নেতাকর্মী ও পরিবারের বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় ফলাও করে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, দলের ভেতরের প্রতিপক্ষই তাকে হত্যা করিয়েছে। তারপরও ঘটনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার পুরনো খেলা হয়েছে।
বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয়রা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং প্রকৃত অরপাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। লোকমানের পরিবারের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, খোকনকে তারা সন্দেহ করেন না। বরং তার সঙ্গে তাদের পারিবারিক সুসম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, নিহত মেয়র লোকমান হোসেনের ভাই কামরুজ্জামান যে মামলা করেছেন তাতে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুসহ ১৪ জনকে আসামি করেছেন। তাতে বিএনপির কেউ নেই, বরং অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
শেষ পর্যন্ত জনমত, পরিবারের দাবি, গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশাসনকে চাপে ফেলেছে। হত্যাকারী কে বা কারা_ তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট হতে পেরেছে। সব হত্যাকাণ্ডের মতো লোকমান হত্যা মামলায় সন্দেহভাজনদের তালিকা থেকে তার প্রতিপক্ষ বাইরে থাকতে পারে না। বলাবাহুল্য, সন্দেহ করা মানেই অপরাধী সাব্যস্ত করা নয়। কে প্রকৃত অপরাধী_ তা নিরূপিত হবে আদালতে। এর আগে সব সন্দেহ, যুক্তিতর্ক, ধারণা বা অনুমানকে আমলে নিতে হবে। প্রকৃত হত্যাকারী এবং হত্যার পেছনের ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে এটি জরুরি পদক্ষেপ।
পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার পর তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ প্রশাসন আসামিদের গ্রেফতারে তৎপরতা দেখায়নি। তবে কর্তব্যে অবহেলার কারণে পুলিশ সুপারসহ তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়_ কেন, কার নির্দেশে প্রশাসন ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল?
কোনো হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে বিবেচনায় আনার বিষয় নিহতের সঙ্গে কার শত্রুতা বা স্বার্থের সংঘাত ছিল। একই দল করলেও লোকমানের প্রতিপক্ষ ছিলেন মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু ও তার ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চু। মন্ত্রীর সঙ্গে লোকমানের সম্পর্ক ছিল অহিনকূল। স্থানীয় কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মন্ত্রী ও মেয়রের অবস্থান ছিল আলাদা। মন্ত্রীর উপস্থিতিতে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় মেয়র লোকমান অংশ নিতেন না। পরপর চার-পাঁচটি সভায় লোকমান অংশগ্রহণে বিরত থেকেছেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে মন্ত্রী নরসিংদীতে নবনির্মিত ডাকঘর ভবন উদ্বোধন করলেও ওই অনুষ্ঠানে মেয়রকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মেয়র লোকমান ও মন্ত্রীর ভাই বাচ্চু। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লোকমানের অনুসারীরা একটি ঝাড়ূ মিছিলও করেছে। এসব ঘটনা পর্যালোচনা করলে সন্দেহের তীর মন্ত্রী ও তার ভাইয়ের দিকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন শুরুতে এসব বিষয়ে নির্বিকার ছিল।
এখন বলা হচ্ছে, পুলিশ নাকি আসামিদের খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ ১৪ নভেম্বর হাইকোর্টে সালাউদ্দিন বাচ্চুসহ ৩ আসামি এসে জামিন চাইলেন, এক ঘণ্টা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাইকোর্টের গেট থেকে তাদের গ্রেফতারের সুযোগ ছিল। কিন্তু তা করা হলো না। বরং আইজিপি বললেন, কৌশলগত কারণে গ্রেফতার সম্ভব হয়নি। এ কৌশলের অর্থ বোঝা কঠিন!
আগের পুলিশ সুপারকে সরিয়ে পরে নতুন পুলিশ সুপার যোগ দেওয়ার পরও পুলিশ কেন আসামি ধরতে তৎপর হচ্ছে না? এর পেছনের কারণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ না বোঝার ভান করলেও জনগণের তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। মন্ত্রী রাজিউদ্দিনের প্রভাব থেকে প্রশাসন মুক্ত থাকতে পারছে না। ১০ নভেম্বর জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ঘনিষ্ঠ সাংসদ নজরুল ইসলাম সালাউদ্দিন বাচ্চুর জড়িত থাকার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, 'আমার মন কিছুতেই বলছে না, এ ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত। কারণ ভালো মানুষের ব্যাপারে আমাকে বলতেই হবে।' সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, তিনি কি প্রশাসনকেও এটি বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছেন?
যতক্ষণ পর্যন্ত রাজিউদ্দিন আহমেদ মন্ত্রীর পদে বহাল আছেন, ততক্ষণ পুলিশের পক্ষে নিরপেক্ষ তদন্ত করা কি সম্ভব হবে? তাই সঙ্গত কারণেই তার পদত্যাগ অথবা অপসারণের প্রসঙ্গ এসে যায়। তাছাড়া মন্ত্রীকে আসামি করা না হলেও ঘটনাপরম্পরায় তাকে সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। যখন তার ভাই ও এপিএস এজাহারভুক্ত আসামি, তখন তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশের পুলিশের বুকের পাটা কি এতই শক্ত যে, মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে?
লোকমান হত্যাকাণ্ডের রহস্য পুলিশকেই উন্মোচন করতে হবে, তবে সরকারকে দিতে হবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অপরাধী যে দলেরই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ গৎবাঁধা উক্তিই যথেষ্ট নয়। এটি বাস্তবায়নে সদিচ্ছার প্রতিফলন দরকার। এ ক্ষেত্রে ভাই রক্ষার নীতি পরিত্যাজ্য।
ভাই রক্ষা প্রসঙ্গে একটি গল্প বলি। শৈশবের ঘটনা। আমার এলাকায় এক ভাই আরেক ভাইকে খুন করে। যথারীতি মামলা হয়। আসামি গ্রেফতারও হয়। তখন এলাকার মোড়লরা নিহতের মাকে বোঝাতে শুরু করলেন যে, তোমার এক ছেলে গেছে, আরেক ছেলে ফাঁসিতে ঝুলবে। তার চেয়ে ওকে কীভাবে বাঁচানো যায়, সেই চেষ্টাই করা উচিত। পরে তেমনটাই হয়েছিল। এমন যুক্তিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা রক্ষার নীতি গ্রহণ করলে তা হবে আইনের শাসনের প্রতি বড় ধরনের চপেটাঘাত।
আইনের শাসন নিশ্চিত করতে লোকমান হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত হোক, অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক_ দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ সেটিই প্রত্যাশা করে। হত্যা-খুনের প্রবণতা রুখে দাঁড়াতে না পারলে একদিন দেখা যাবে জনপ্রিয়, মেধাবী ও প্রজ্ঞাবানরা রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে হারিয়ে গেছেন। জোরদার হয়েছে সন্ত্রাসী ও দুর্জনদের আধিপত্য। এমন অরাজক অবস্থা কি আমাদের কারও কাম্য?

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.