টিপাইমুখ : ভারত কথা রাখেনি সরকারও মুখ খুলছে না-জাতিসংঘে যাওয়ার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা by মেহেদী হাসান

প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অব্যাহত উদ্বেগের মধ্যে গত বছর ভারত সুস্পষ্টভাবে কথা দিয়েছিল_বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু করবে না তারা। এর পরও গত ২২ অক্টোবর বাংলাদেশকে না জানিয়ে অনেকটা গোপনে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিনিয়োগচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ বাঁধ নিয়ে বিতর্ক আছে খোদ ভারতেও।


এর পরও বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে ভারত এ দেশকে দেওয়া কথা ও আশ্বাসের বরখেলাপ করেছে বলে মনে করেন বর্তমান ও সাবেক কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। একটি ভাটির দেশকে না জানিয়ে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর উজানের দেশে বাঁধ নির্মাণ করা আইনসম্মত নয় বলেও তাঁরা মনে করেন। এ বিষয়ে তাঁরা সরকারকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে সরকার এখনো মুখ খুলছে না।
ঢাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে জানান, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে তাঁরা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারতের বিনিয়োগচুক্তি স্বাক্ষরের কথা জানতে পারেন। এরপর তাঁরা ওই খবরের সূত্রও অনুসন্ধান করেন। ওই কর্মকর্তা জানান, গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত যৌথ ইশতেহারে টিপাইমুখ বাঁধের প্রসঙ্গটি স্থান পেয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে_'ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।' এরপর গত সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময়ও অনুরূপ আশ্বাস এসেছে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, বাংলাদেশ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে আপত্তি জানিয়ে বলেছে। বাঁধ দিলে এ দেশের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর পরও ভারত ওই বাঁধ নির্মাণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। তিনি জানান, বাংলাদেশ গত শনিবার কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করলে ওই সময়ও এ দেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু না করার আশ্বাস দেয় ভারত। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করেও বাংলাদেশের ক্ষতি না করা কিভাবে সম্ভব, তা তাঁর বোধগম্য নয় বলে তিনি জানান।
ওই কর্মকর্তা জানান, দৃশ্যত ভারত বাংলাদেশের কাছে বিষয়টি গোপন রেখেছে। আন্তর্জাতিক একটি নদীর ক্ষেত্রে উজানের দেশ ভাটির দেশকে না জানিয়ে ভারত বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না। ভারত এ বিষয়টি বাংলাদেশকে জানাতে পারত। এমনকি গত ১০ নভেম্বর মালদ্বীপে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের সময়ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ওই চুক্তি ও বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগের কথা জানাতে পারতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক গতকাল রবিবার দুপুরে কালের কণ্ঠকে বলেছেন, 'টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের হঠাৎ চুক্তির খবর বাংলাদেশকে হতাশ করেছে। নিঃসন্দেহে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ এটা প্রত্যাশা করেনি। এটি তাদের কথার বরখেলাপ। তিনি আরো বলেন, কূটনৈতিক চ্যানেলে ওই চুক্তি ও টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারত সরকারের উদ্যোগের ব্যাপারে জানার চেষ্টা চলছে। এর পরই পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এম আর ওসমানী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কথার দাম নাই, চুক্তিরও দাম নাই। বাংলাদেশ সরকার তো কোনো প্রতিবাদ করে নাই। অথচ দেশটার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।' তিনি বলেন, 'ভারত প্রতিটি নদী থেকে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তিস্তার ন্যায্য পানি দেওয়া তো দূরের কথা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করবে। এতে আমাদের সিলেট অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। সিলেট অঞ্চলের মন্ত্রিরাও চুপ। তাঁদের মুখে এ ব্যাপারে কোনো কথা নেই।'
বাংলাদেশকে না জানিয়ে ভারত এভাবে চুক্তি করতে পারে কি না জানতে চাইলে এম আর ওসমানী বলেন, 'ভারত তো তাদের স্বার্থ দেখবেই। আমরা তো আমাদের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছি।' বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু না করার ব্যাপারে মনমোহন সিংয়ের আশ্বাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'মনমোহন সিং ভালো লোক। কিন্তু ভারতে সিদ্ধান্ত তো আসে অন্যদের কাছ থেকে।'
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে এম আর ওসমানী বলেন, বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে ভারতের কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারবে না। টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে বাংলাদেশের জাতিসংঘে ও জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক ফোরামে যাওয়া উচিত। চলতি মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠেয় জলবায়ু সম্মেলনে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুটি বাংলাদেশের তোলা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ হলে কেবল ভারত নয়, বাংলাদেশের ওপরও তার প্রভাব পড়বে। টিপাইমুখে আসলে ভারত কী করতে চাচ্ছে, তা আমরা জানি না। প্রথমে বলা হয়েছিল, ভারত টিপাইমুখ ও ফুলের তলায় সেচ প্রকল্প করবে। পরে শোনা যায়, ফুলের তলায় সেচ প্রকল্প হচ্ছে না। প্রকৃত বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও কারিগরি তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের মধ্য দিয়েই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, যা দুই দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হয়। তিনি আরো বলেন, 'পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে চুক্তির ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। আমি মনে করি, দুই দেশের সর্বস্তরেই তথ্য বিনিময় ও আলোচনা হওয়া উচিত।'
রবিবার ছুটি থাকায় ভারতের কাছ থেকে তথ্য পেতে বাংলাদেশের আজ সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বর্তমান যুগে শনি, রবিবার ছুটির দিনেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়। এর পরও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ব্যাপার থেকে যায়, যার জন্য অফিস খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।' তিনি বলেন, 'আমি ওই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি। তবে মূল বিষয় হলো, আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হোক।'
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শমসের মুবিন চৌধুরী বলেন, 'এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আলোচনার দরকার ছিল।' বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে শক্তভাবে তুলে ধরা দরকার। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট আশ্বাস ছিল। এ নিয়ে আলোচনা করা দরকার।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'ভারত বাংলাদেশকে এক ধরনের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে, যার জন্য এ দেশের জনগণ কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। ভারত আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন করেছে। ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অনেক ছাড় দিয়েছে। এভাবে ছাড় দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা এখন বাংলাদেশকে ভাবতে হবে। ট্রানজিটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের স্বার্থকে কতটা ছাড় দেবে, তাও সরকারকে ভাবতে হবে।'

No comments

Powered by Blogger.