আদ্দু ঘোষণা ও সার্কের ভবিষ্যৎ by ফরিদুল আলম

০ দফা আদ্দু ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে সপ্তদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। আপাত দৃষ্টিতে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত এবারকার সার্ক শীর্ষ সম্মেলনকে প্রতিবারের মতো আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের একটা বাধ্যবাধকতা মনে হলেও বাস্তবিক অর্থে অন্যান্য সম্মেলনের চেয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এবারকার সম্মেলন বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এবারই সম্ভবত সব সদস্যদেশের শীর্ষ নেতা প্রথমবারের মতো ইতিপূর্বে গৃহীত বেশ কিছু বিষয় বাস্তবায়নের প্রতি তাগিদ


দিয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা (সাফটা) দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সদস্যদেশগুলোর একত্রে কাজ করা, যোগাযোগব্যবস্থা (কানেকটিভিটি) সম্প্রসারণ এবং এ ক্ষেত্রে জল ও স্থল উভয় পথের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা; সেই সঙ্গে সত্বর বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু, ভারত মহাসাগরে কার্গোবাহী ও যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সার্ক মহাসচিবকে দায়িত্ব প্রদান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কৌশল আরো জোরদার করা, সন্ত্রাসবাদ রোধকল্পে কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী-পুরুষের সমতা আনয়নকল্পে সমন্বিত আঞ্চলিক কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং সঠিক সময়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিশ্চিত করা এবং সর্বোপরি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের জাতীয় আয়ের ২ শতাংশ এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা।
উপরোক্ত বিষয়ের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এবারকার সার্ক সম্মেলন সত্যিকার অর্থেই বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং এ ক্ষেত্রে সমন্বিত কাজ করার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সম্মেলনে বিভিন্ন সরকারপ্রধানের বক্তব্য থেকেও ঘুরেফিরে এই বাস্তবতাই প্রকাশ পেয়েছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে দক্ষিণ এশিয়ার সামর্থ্য এবং এর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বৈশ্বিক উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ার ভূমিকার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করে দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একে একটি পাওয়ার হাউসে পরিণত করার ওপর জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একই ধরনের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধারণ সত্ত্বেও ভৌগোলিক সীমারেখা তাদের জাতিসত্তা বিকাশের পথে বিভিন্নভাবে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। শেখ হাসিনা জনসাধারণ ও শ্রমের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এ অঞ্চলের উন্নয়নের যে ফর্মুলা দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সেই সঙ্গে তিনি অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনার গ্রহণযোগ্য সমাধান এবং পরিবহন সংযোগ সম্প্রসারণ ও অবাধ বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাজার সম্প্রসারণের ব্যাপারে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন। এবারকার সম্মেলনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি হলো, ভারত কর্তৃক সাফটার মাধ্যমে ট্যারিফ বাধা অপসারণ করে স্পর্শকাতর পণ্য-তালিকা ৪৮০ থেকে ২৫টিতে নামিয়ে আনার এবং সেসব পণ্যের শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
এবারকার সম্মেলনে সার্কের ৯টি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ও সংগঠনের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। এবারই প্রথম সব পর্যবেক্ষক সার্ক সম্মেলন সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ পায়। সার্ক যে বাস্তবিক অর্থেই একটি সম্ভাবনাময় সংস্থা, তা প্রকাশ পায় পর্যবেক্ষকদের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে। সেই সঙ্গে পর্যবেক্ষকদের কারো কারো সার্কের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ পায় তাদের বক্তব্য থেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইরান ও চীন। যদিও তাদের অবস্থান ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে, কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে দক্ষিণ এশিয়ার নৈকট্য অনুভব করে। যেমন_ইরানের প্রতিনিধি তাঁর বক্তব্যে ইরান এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্যের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। সার্কের উন্নয়নে পর্যবেক্ষকদের বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকারের মাধ্যমে এ কথাই প্রতীয়মান হয়, ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামো বিনির্মাণে সার্কভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্বদানের রয়েছে উন্মুক্ত সম্ভাবনা এবং এর জন্য সব উপাদানই দক্ষিণ এশিয়ার রয়েছে। প্রয়োজন কেবল নিজেদের যোগ্যতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। পর্যবেক্ষকদের বর্তমান ভূমিকা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সার্ক তার বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে আর্থিক ও কারিগরি সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে খুব সহজেই। এবারকার সম্মেলনে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র এবং সংস্থার কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা লাভের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও চীন যথাক্রমে ২০ মিলিয়ন ও তিন মিলিয়ন ডলার সার্ক তহবিল প্রদানের অঙ্গীকার ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া সার্ক সদস্যদেশগুলোর জন্য উচ্চতর পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য ২৯৭টি বৃত্তি প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। সার্কের অন্যতম পর্যবেক্ষক ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯৬ সাল থেকে সার্ককে বিভিন্ন কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছে এবং সম্প্রতি তারা সার্ক সিভিল এভিয়েশনের উন্নয়নে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছে। সেই সঙ্গে আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দিলি্লতে অবস্থিত সার্ক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের মাধ্যমে দুর্যোগের ভয়াবহতা হ্রাসকল্পে কারিগরি সহায়তা প্রদানেরও অঙ্গীকার করেছে।
এবারকার সার্কের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এবারই প্রথম শীর্ষপর্যায়ের আলোচনায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সার্ক সম্মেলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তাঁরা কার্যত তাঁদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ১৫০ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষাকেই প্রতিধ্বনিত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন রাষ্ট্রে যে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটেছে, তা সংস্থা হিসেবে সার্কের যে আদর্শগত ধারণা আছে, তাকে আরো উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের যে অভিন্ন হুমকি রয়েছে, তা মোকাবিলায় সদস্যরাষ্ট্রগুলোর পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামো সফলভাবে কাজ করতে পারে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে সার্কভুক্ত দেশগুলোর বর্তমান নেতৃত্ব আগের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার জনসাধারণের আর্থসামাজিক মুক্তির ব্রত নিয়ে আজ থেকে ২৬ বছর আগে যে সার্ক ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, সময়ের পথপরিক্রমায় মালদ্বীপের 'আদ্দু ঘোষণা'র মধ্য দিয়ে তার পরিপক্বতার প্রমাণ রাখতে পেরেছে বলে মনে হয়। তবে এ কথাও সত্য, প্রতিবছর সম্মেলন শেষে যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবে আলোর মুখ দেখে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সার্কের ঘোষণাপত্র রাজনৈতিকভাবে গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব বর্তায় আমলাদের ওপর। সুতরাং এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়সাধন ব্যতিরেকে সার্কের সুফল লাভ করা দুরূহ ব্যাপার। ভারত কর্তৃক স্পর্শকাতর তালিকা হ্রাসকরণের মাধ্যমে সার্কভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরো প্রসারিত হবে। সর্বোপরি সার্ক বিগত বছরগুলোর হতাশা কাটিয়ে উঠে আগামী দিনগুলোতে একটি স্বপ্নের দক্ষিণ এশিয়া উপহার দিতে পারবে_এই প্রত্যাশা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার।

লেখক : চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
mfulka@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.