টিপাইমুখ বাঁধ-প্রতিশ্রুতি রক্ষাই বন্ধুত্বের নিদর্শন

বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারার যৌথ উজান বরাক নদীতে ভারতের পক্ষে প্রকল্পায়িত টিপাইমুখ বাঁধ তথা জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কারণে সীমান্তের দু'পাশে পরিবেশগত, ভূতাত্তি্বক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। এখন প্রকল্পটির নির্মাণকাজের ব্যাপারে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি সংস্থা ও মণিপুর রাজ্য সরকারের মধ্যে যেভাবে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো তা বৃহৎ প্রতিবেশীটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়া


প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন ও রেওয়াজ লঙ্ঘনের নিকৃষ্ট নজির হয়ে থাকবে। এ উদ্যোগ খোদ ভারতের পরিবেশ বিষয়ক আইনের, যেখানে নদীতে বাঁধ ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের আগে সার্বিক পরিবেশগত সমীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে, এর প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে এ ব্যাপারে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে সম্পূর্ণ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও ব্যাখ্যা দাবি করা। দু'দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী নয়াদিলি্ল এ ব্যাপারে বাধ্যও বটে। ওই চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, অভিন্ন নদীর ব্যাপারে কোনো পক্ষই একক এবং অন্যের জন্য ক্ষতিকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না। টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে অনেকটা গোপনে বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারতীয় পক্ষ দুটি শর্তই রক্ষা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমরা গভীর বিস্ময় ও বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, আমাদের প্রতিবেশী দেশটি তাদের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না। গত বছর জানুয়ারিতে ভারতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফর এবং এ বছর সেপ্টেম্বরে তাদের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ফিরতি সফরে যে দুটি যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে, ভারতীয় পক্ষ কি তা অস্বীকার করতে পারবে? ওই দুই দলিলে সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে_ টিপাইমুখে এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া বক্তৃতায়ও মনমোহন সিং বলেছিলেন, 'টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। আমি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এটা পরিষ্কার করতে চাই যে, ভারত সেখানে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যা বাংলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।' দুর্ভাগ্যবশত এর উল্টো চিত্রই আমরা এখন দেখছি। তাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ আর যা-ই হোক, বন্ধুত্বের নিদর্শন হতে পারে না। ভারতীয় পক্ষের কাছে এও পরিষ্কার করা জরুরি যে, টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুটি নিছক প্রতিবেশীর প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয় নয়। অভিন্ন নদীতে নির্মিতব্য স্থাপনার ব্যাপারে তথ্যপ্রাপ্তি এবং সম্মতি-অসম্মতি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার মতোই আমাদের অবিসংবাদিত অধিকার। করপোরেট মুনাফা ও আঞ্চলিক প্রভাবের কাছে সে অধিকার বিসর্জনের অবকাশ নেই। আমাদের সরকারের পক্ষে এও প্রাঞ্জল ভাষায় জানিয়ে দেওয়া উচিত, ভারত টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রত্যাশামতো পদক্ষেপ না নিলে ঢাকার পক্ষে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সালিশি মাধ্যমে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। আমরা নিঃসন্দেহে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সমমর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ককে গুরুত্ব দিই; কিন্তু ন্যায্য অধিকার ও দেশের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নটি তারও আগে।

No comments

Powered by Blogger.