সংসদ সচিবালয়ের উপ-সচিবের এত সম্পদ! by মারুফ কিবরিয়া
সরকারি এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) একাধিকবার জমা পড়েছে অভিযোগ। প্রথমবার সংস্থাটি সেটি আমলে নিলেও খতিয়ে দেখতে সংসদ সচিবালয়ে পাঠিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আবারো অভিযোগ দেয়া হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, দ্বিতীয় স্ত্রীর নির্যাতন ও যৌতুক মামলায় গ্রেপ্তারের পরপর এই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে। সে অবস্থায়ই অবসরে যান দিদারুল।
সরজিমন দেখা যায়, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার ১৪ নম্বর সড়কে ৯৯ নম্বর বাড়িটি সংসদ সচিবালয়ের এই কমকর্তার।
তিন বছর আগে নির্মাণ করা হয়। তবে আটতলা পর্যন্ত সবক’টি ফ্লোরের কাজ শেষ করেছেন দিদারুল। বাড়ির সামনে কোনো নামফলক না থাকলেও নিচতলায় ছোট একটি অফিস কক্ষ রয়েছে। যেখানে তার নাম ও কর্মস্থলের পদবি লেখা রয়েছে। সেই বাড়ির ফটকে গিয়ে কড়া নাড়লে এক নারী বের হয়ে আসেন। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ওই নারীর আলাপে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় আটতলাবিশিষ্ট এই বাড়ির মালিক উপ-সচিব দিদারুল আলম চৌধুরী। পরিচয় জানতে চাইলে ওই নারী জানান, বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব পালনকারীর (কেয়ার টেকার) স্ত্রী তিনি। এমনকি নামও বলতে চাননি। অবশ্য ওই নারীই বলেছেন, বাড়িটি দিদারুল আলম চৌধুরীর। তার সঙ্গে কথোপকথনের সময় গ্যারেজে নীল রঙের গাড়ি দেখা যায়। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-২৫-৮৩৩১। ওই গাড়িটিও সরকারি এই দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপ-সচিব দিদারুল আলম চৌধুরী মোহাম্মদপুরের ওই বাড়ি থেকে প্রতি মাসে ২ লাখ টাকার বেশি পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন। প্রতিটি ফ্ল্যাট সাড়ে ১৩ হাজার করে ভাড়া দেন। শুধু তাই নয়, অষ্টম তলায় ছাদের উপর দু’টি ছোট পরিবার থাকার মতো ঘরও তৈরি করেছেন দিদারুল।
জানা গেছে, চাকরিতে যোগদান করেন পার্সোনাল অফিসার (পিও) পদে। সরকারি চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির (১০ম গ্রেডের) এ কর্মকর্তার মাসিক মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ৯ হাজার ৬শ’ টাকা এবং অন্যান্য ভাতা ১৫শ’ টাকা মিলিয়ে সাকুল্যে ২৭ হাজার ১শ’ টাকা। এই বেতনে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় বসবাসের পাশাপাশি সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে চাকরির সুবাদে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে। চাকরিজীবনে অফিস আদেশ-বহির্ভূত জার্মানিতেও ছিলেন দিদারুল আলম। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তিনি পদোন্নতি পেয়ে উপ-সচিব হয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি একাধিক বিয়ে করেছেন। প্রথম ঘরে একটি ছেলে এবং দ্বিতীয় ঘরে ৩ মেয়ে রয়েছে। তাদের প্রত্যেককে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
দিদারুলের যত সম্পদ: ঢাকা উদ্যানের নবীনগর হাউজিংয়ে সাততলা বাড়ির জমিটি দিদারুল আলম কেনেন ১৯৯৭ সালে। তৎকালে তিনি পার্সোনাল অফিসার (পিও) পদে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া মিরপুর পর্বতা মৌজায় ৬.৫ শতাংশ ভূমি, রামচন্দ্রপুর মৌজায় সিএস ও এসএ ৪৬৮ নং দাগে ৫২০০ অযুতাংশ ভূমি, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুরে স্বপ্ননগর আবাসিক ফ্ল্যাট প্রকল্পের ভবন নম্বর ১-এর এ/১ নম্বরে ১৫৪৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বুকিংকৃত। অন্যদিকে রাজধানীর বিএনপি বাজার এলাকায় দু’টি দোকানও রয়েছে দিদারুল আলমের নামে।
যত অভিযোগ: সূত্রমতে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ১৯৯৩ সালে তিনি জার্মানিতে যান। জার্মানি থেকে ফিরে কৌশলে আবার সংসদ সচিবালয়ে যোগদান করেন দিদারুল আলম চৌধুরী। দ্বিতীয় স্ত্রী মারফেতুন্নেছার দায়ের করা নারী নির্যাতন ও ভরণ-পোষণ মামলায় দিদারুল আলমকে ২০২৩ সালের ২৩শে জুন সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর আদেশক্রমে সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মাহবুব জামিল স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়- মো. দিদারুল আলম চৌধুরীকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-২,
ঢাকার মামলা নং ৯২/২০২৩তে অভিযুক্ত হয়ে গত ৫ই জুন হতে জেলহাজতে অবস্থানের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস পার্ট-১ এর বিধি ৭৩ (২) ও সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ এর ৩৯ (২) ধারা মোতাবেক ৫ই জুন থেকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি বিধি মোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন। অবশ্য বিশদিন জেলে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে মুক্ত হন দিদারুল আলম।
২০২৩ সালের ২রা মার্চ দিদারুল আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। অভিযোগ দাখিল করেছেন তারই স্ত্রী মারফেতুন্নেছা। দিদারুল সংসদ সচিবালয় থেকে ‘এ’ টাইপের বাসা পেতেন। তিন রুমের সেই বাসাটি সাবলেট হিসেবে এক পরিবারকে ভাড়া দিয়েছিলেন। সেই পরিবার থেকে মাসে ২২ হাজার টাকা আদায় করতেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ায় সংসদের বাসা বাতিলের জন্য চিঠি দেন স্পিকারকে। অবশ্য বর্তমানে অবসরে যাওয়ায় সরকারি বাসাটি এখন আর দিদারুল আলমের নামে নেই। দিদারুল আলম চৌধুরী ১৯৮৬ সালে সংসদ সচিবালয়ে যোগদান করেন পার্সোনাল অফিসার (পিও) পদে। তার বর্তমান পদ উপ-সচিব। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে এ পদোন্নতি হয়। এরও আগে তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব (৬ষ্ঠ গ্রেড) পদে ৬ থেকে ৭ বছর কাজ করেছেন। তার আগে ছিলেন নবম গ্রেডের সহকারী সচিব।
অভিযোগের বিষয়ে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় দিদারুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে। কিন্তু তিনি কোনোবারই ফোন রিসিভ করেননি।
No comments