গাজী টায়ারসে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ: কী ঘটেছিল সেদিন? by নাজমুল হুদা

রূপগঞ্জে ৯৬ বিঘার উপর গাজী টায়ারস কারখানা। আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে পুরো কারখানাটি। অতি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভবনটিতে চালানো যাচ্ছে না উদ্ধার কাজও। অগ্নিসংযোগের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। তাদের সন্ধান পেতে এখানো কারখানার সামনে আসছেন স্বজনরা। এখন পর্যন্ত কোনো মরদেহের আলামত পায়নি উদ্ধারকারী দল। তবে রোববার নিখোঁজের স্বজনরা মানুষের হাড় ও মাথার খুলি সদৃশ বস্তু উদ্ধার করেছেন। বর্তমানে কারখানাটির প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা ও প্রশাসনিক ব্যক্তি ছাড়া ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না কাউকেই। ২৫শে আগস্টের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় ও কারখানা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জমিজমা সংক্রান্ত দ্বন্দের জেরে লুটপাট করা হয় কারখানায়। তবে লুটপাটের সময় কারখানার ভেতর ৩টি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তারপরও একটি গ্রুপ সেখানে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায়। এ সময় ভবনের উপরের তলায় অনেকেই আটকা পড়ে যান।

সূত্র জানায়, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তারের খবরের পরই ঘটে গাজী টায়ারস কারখানায় লুটপাটের ঘটনা। তবে লুটপাটের আগে খাদুন উত্তরপাড়া মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ জড়ো করা হয় কারখানার সামনে। একপর্যায়ে কারখানার পূর্ব পাশ দিয়ে খাদুন এলাকার একটি গ্রুপ কারখানার ভেতর লুটপাট করে। ওদিকে প্রধান ফটক দিয়ে আরেকটা গ্রুপ ঢুকে লুটপাটে অংশ নেয়। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র বলছে, গত ৫ই আগস্টও লুটপাট হয় কারখানায়। তার কিছুদিন পর থেকে স্থানীয় সাবেক কমিশনার বিএনপি নেতা তোফাজ্জেল হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা রায়হান মোল্লা, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা রায়হান মীরের ভাই ছাত্রলীগ নেতা রবিনসহ ২০ জনের একটা গ্রুপ প্রতিদিন ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে কারখানা পাহারা দিতো। তবে তারা প্রতিদিন জনপ্রতি ৫ হাজার করে এক লাখ টাকা দাবি করে কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে। সেটা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মসজিদে মাইকিং করে পাহারা দেয়া ওই গ্রুপটি। মসজিদের মাইকে গাজী গ্রুপের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে দ্বন্দে জড়ানো মালিকদের মানববন্ধন করার জন্য ডাকা হয়। মাইকে ঘোষণার পর তারা কারখানায় লুটপাট শুরু করলে সাধারণ পথচারী ও আশেপাশের কারখানার শ্রমিকরা লুটপাট শুরু করেন। এ সময় অনেকের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল বলেও জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। লুটপাটের খবর ছড়িয়ে পড়ায় বরাবো এলাকা থেকে শহিদুল ওরফে ডাকাত শহিদুল ৫০ জনের একটা গ্রুপ নিয়ে লুটপাটের জন্য কারখানায় ঢুকে পড়ে। তখন আগের লুটপাটকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় শহিদুলের গ্রুপের। এ সময় বন্দুকের গুলির মতো শব্দও পান এলাকাবাসী। এ ছাড়া ওইদিন চনপাড়ার আরও একটি গ্রুপের সঙ্গেও সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে একটি গ্রুপ কারখানার নিচতলায় অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায়।

গাজী টায়ারস কারখানার পাশেই রূপসী বাসস্ট্যান্ড। সেখানের স্থানীয় দুই সিএনজি চালক মো. উজ্জ্বল ও মিরাজ জানিয়েছেন, আগুন লাগার পরও প্রতিদিন লুটপাট হয়েছে কারখানায়। চনপাড়া, ডেমরা, কাঁচপুর, গাউছিয়াসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন এসে লুটপাট করেছে। অনেকে রিকশা, ভ্যান, অটো, পিকাপ ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। এক গ্রুপ ভিতর থেকে বাইরে মালামাল বের করেছে। আরেক গ্রুপ বাইরে থেকে তা বিক্রি করতে নিয়ে গেছে। গাজী টায়ার্সের অপারেটর শহিদুল ইসলাম ঘটনার দিন কারখানায় ছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, সেদিন শতশত মানুষ এসে হামলা, লুটপাট করে। আমরা পরে দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে যাই। তাদের বাধা দেয়ার কেউ ছিল না।  

এদিকে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখন পর্যন্ত অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। ঘটনার এক সপ্তাহ পরও কারখানার বাইরে নিখোঁজ হওয়া স্বজনদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন অনেকে। গতকাল সকালে হাতে সন্তানের ছবি নিয়ে গাজী টায়ারস কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মোকসেদ আলী। তার ছেলে রেজাউল করিম ২৫ আগস্টের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। রেজাউল একটি মশারির কারখানায় কাজ করতেন। বাবা মোকসেদ আলী বলেন, আমার ছেলে সেদিন এখানে দেখতে আসছিল। সেদিন রাত থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। মোবাইল নম্বরও বন্ধ। ছেলে মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে তাও জানি না। শিশু ইসমাইলের (১৪) খোঁজে কারখানার গেটের সামনে বসেছিলেন মা বেদেনা। ইসমাইল মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতো। বেদেনা বলেন, সেদিন সন্ধায় ছেলেটা মাদ্রাসায় গেল। কিন্তু মাদ্রাসা থেকে কখন বের হইছে, কোথায় গেছে জানি না। ছেলের আর খোঁজ পাচ্ছি না। আমার একটাই সন্তান। তারে ছাড়া কেমনে থাকবো। কারখানায় এসে ছেলের ছবি আর জন্ম নিবন্ধন জমা দিয়েছেন বলেও জানান বেদেনা। ভাগ্নে নিহাদের খোঁজ নিতে এসেছেন রুবেল। নিহাদও ২৫শে আগস্টের পর থেকে নিখোঁজ। একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজে কাজ শিখতো নিহাদ। প্রতিদিন সকালে গ্যারেজে দিয়ে রাতে আবার বাসায় ফিরতো। কিন্তু সেদিন রাতে আর বাসায় ফিরেনি। রাতে মামা রুবেল কারখানায় এসে খোঁজ নেয়। রুবেল বলেন, ভবনের ভেতরে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু আগুনের কারণে পারিনি। এখন পর্যন্ত তার কোনো খবর নেই।

উদ্ধারকারী টিম মানুষের দেহাবশেষ খুঁজে না পেলেও নিহতের স্বজনেরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঢুকে মানুষের হাড়, মাথার খুলিসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করেন। পরে সেগুলো পুলিশের কাছে দেন। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ ৮০ জনের তালিকা করেছে জেলা প্রশাসন গঠিত ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি। গতকাল দুপুরে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, এখন তদন্ত চলমান রয়েছে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। বুয়েটের একটা বিশেষ দল ভবন দেখে জানিয়েছে এখানে উদ্ধার কাজ চালানো যাবে না। এটা অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর কী ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিবেন।

No comments

Powered by Blogger.