কসবা-আখাউড়ার দাপুটে চেনা মুখগুলো আত্মগোপনে by জাবেদ রহিম বিজন

অনুষ্ঠান মঞ্চে মন্ত্রীর দু’পাশের চেয়ারে উপস্থাপকের ঘোষণার আগেই আসন নিয়েছেন তারা। আলোচিত সেসব মুখের দেখা নেই এখন। সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন সবাই। অথচ এই ক’দিন আগেও কসবা ও আখাউড়া কাঁপিয়েছেন। তাদের কথা ছাড়া কিছুই হয়নি। অবৈধ কাজ-কারবারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার তালিকা তাদের নামেই ভরা।

সায়েদুর রহমান স্বপন সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হকের আপন ফুফুর ছেলে। তার এই ফুফাতো ভাই গত মে মাসে কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগে কুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। কুটির পর গোটা উপজেলা শাসন করার সুয়োগ আর তার হয়নি। কুটির চেয়ারম্যান, ব্যবসায়ী সমিতির পদ, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ, সবই ছিল তার দখলে।

আলোচনা আছে উপজেলার ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ ওই ইউনিয়নের নানা খাত থেকে টাকা কামিয়ে পাঠিয়েছেন আমেরিকায় পরিবারের কাছে। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলে মামলার আসামি হয়েছেন দলের অনেক নেতাকর্মী। আনিসুল হকের মন্ত্রীত্বের পুরো সময়ে উপজেলায় স্বপনের মতো সময়ে সময়ে আরও কিছু ক্ষমতাধর মুখ সামনে এলেও আখাউড়ায় ছিল তাকজিল খলিফা কাজলের শাসন। ওই উপজেলায় মন্ত্রী মানে কাজল, কাজল মানেই মন্ত্রী। ১০/১১ বছর ধরে কাজলের বগলদাবা ছিলেন মন্ত্রী। আর এই সুযোগে কাজল অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। ছাত্রলীগ নেতা থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তিনবারের মেয়র, অসীম ক্ষমতাধর কাজল সরকার পতনের পর পুকুরে লাফিয়ে পড়ে পালিয়েছেন। এখন আর তার খবর নেই। কাজলের ডানহাত-বামহাত হিসেবে পরিচিত আবদুল মোমিন বাবুল ওরফে এ্যারো বাবুল, লাকসু খলিফা, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহবুদ্দিন বেগ শাপলু এলাকায় নেই। এ্যারো বাবুল মাদক ব্যবসা, থানার দালালি এবং উপজেলায় তদবির করে ভাগ্য ঘুরিয়েছেন। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কারিমা নামে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট রয়েছে তার। লাকসু সিএনজি স্টেশন ও বন্দরে পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি করতো। বেপরোয়া শাপলুও নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন।    

আনিসুল হক প্রথম মন্ত্রী হওয়ার পর তার এপিএস হন তার আইন পেশার সহকারী এডভোকেট রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন। কসবায় জীবন, আখাউড়ায় কাজল। এ দু’জনের বাইরে মন্ত্রীর কাছে এক্সেস ছিল না আর কারও। মন্ত্রীর পরই আসতো এ দু’জনের নাম। ঢাকা থেকে কসবা, সবই জীবনময়। চাকরি-বদলি বাণিজ্যে ফুলে ফেঁপে ওঠার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি সবসময় বলে বেড়িয়েছেন, ‘দেশের ১৬ কোটি মানুষের কেউ বলতে পারবে না মন্ত্রী বা তাকে এক কাপ চা খাইয়েছে।’ অবশ্য এখন বদলি-চাকরি এসবের কোনোটাই টাকা ছাড়া হয়নি বলে অভিযোগ আসছে। সাবেক আইনমন্ত্রী তার দু’মেয়াদে ২ হাজারের বেশি লোককে চাকরি দেন। এজন্যে কাউকে এক পয়সা দিতে হয়নি বলে সবসময় এলাকার সভা-সমাবেশে বলেছেন তিনি। জীবন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে এলাকায় চলে আসলে মন্ত্রীর দুই পিএ আলাউদ্দিন বাবু ও সফিকুল ইসলাম সোহাগ হয়ে উঠেন ক্ষমতাধর। জীবনকে ছেড়ে চাকরি, বদলি প্রত্যাশীরা তাদের দুয়ারে ধরনা দিতে শুরু করেন। এসব কাজের জন্য স্থানীয় সিন্ডিকেট সৃষ্টি করেন। সীমান্তের এই উপজেলায় মাদক চোরাচালানীসহ নানা অপকর্মে নেপথ্যের মদতদাতা হয়ে ওঠেন তারা। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে জীবনকে টেক্কা দিয়ে মন্ত্রীর ভাই স্বপনকে জয়ী করাতে মাঠে নামেন দুই পিএ। ভোটার শূন্য কেন্দ্রে ভোটের বন্যা বইয়ে দিয়ে স্বপনকে বিজয়ী করেন। অবশ্য মন্ত্রীর সাবেক এপিএস আর ভাইয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ নির্বাচনে স্থানীয় মডেল মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসে তার নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচনের পর থেকে জীবনের সঙ্গে মন্ত্রীর দূরত্ব দেখা দেয়। জীবন এলাকা থেকে চলে যান।  

পিএ বাবুর পিতা ইদ্রিস মিয়া মন্ত্রীর গ্রামের বাড়ি পানিয়ারূপের কেয়ারটেকার। বাবুও ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত  মন্ত্রীর অফিসে আগতদের চা পরিবেশন করতেন। পিএ হয়ে আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়ে বসেন। শত কোটি টাকার মালিক বনেছেন এই ক’বছরে। সাব রেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রার বদলির শতকারা ৯০ ভাগ এই দুই পিএ সম্পন্ন করেছেন। আরেক পিএ সোহাগ একসময় পানিয়ারূপ গ্রামে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন বলে স্থানীয়রা জানান।

মন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার আর পিএ ছেলের জোরে দ্বিতীয় মন্ত্রী হয়ে উঠেন ইদ্রিস মিয়া। তার বেয়াই বাবুর শ্বশুর ফরিদ মুহরী, মেয়ের জামাই আমজাদ হোসেন, পানিয়ারূপ গ্রামের আরেক স্কুল শিক্ষক দেলোয়ার ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। সিন্ডিকেট করে নানাভাবে টাকা কামাইয়ে নামেন তারা।   

২০১৬ সালে পৌরসভা নির্বাচনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এমরান উদ্দিন জুয়েলকে মেয়র বানিয়ে চমক দেখান মন্ত্রী। জুয়েলের দিন বদলের গল্প শুরু হয় সেখান থেকে। লাকসাম-আখাউড়া রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হলে আখাউড়া অংশে কাজল আর কসবায় জুয়েল সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে তমা গ্রুপের সঙ্গে কাজ করেন। কসবা পৌরসভার গাড়ি ব্যবহার করেও রেলপথ নির্মাণ কাজে মাটি-বালু সরবরাহের অভিযোগ ওঠে জুয়েলের বিরুদ্ধে। পুলিশ মাদক চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ায় সে সময় থানার ইট খুলে নেয়ার হুমকি দিয়েও আলোচিত হন জুয়েল। কাজল রেলপথে বালু দিতে ভবানীপুরে বালু মহাল সৃষ্টি করেন। এতে এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। জুয়েলের পর ২০২৩ সালে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া হয় যুবলীগ নেতা এমজি হাক্কানীকে। পৌরসভার কোনো কাজ ঠিকভাবে না করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার ছোট ভাই টি আলী কলেজের প্রদর্শক গোলাম আজমও কলেজ ছেড়ে ঠিকাদারি কাজের হর্তাকর্তা হয়ে ওঠেন। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান ঠিকাদারি ব্যবসায়। উপজেলার সকল ঠিকাদারি কাজ কব্জা করেন। ২০১৭ সালে কসবা মহিলা ডিগ্রি কলেজে ২ কোটি টাকায় একটি ভবন করার কাজ পান আজম। কাজ করেন অনেক নিম্নমানের। এর প্রতিবাদ করায় শাসান অধ্যক্ষ মো. তসলিম মিয়াকে।

কাইয়ুমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইখতিয়ার আলম রনি, বায়েক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বিল্লাল হোসেন মাদক, চিনি, কাপড় এবং গরু চোরাচালানের বেপরোয়া নাম। কসবা পশ্চিম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মানিকও টাকা কামিয়েছেন পিএ সোহাগের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে।

স্বপনের দখলে কুটি: এক সময় কুটিতে একটি আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিক ছিলেন সায়েদুর রহমান স্বপন। বাড়িতে ছিল টিনের চৌচালা ঘর। এখন সেখানে একাধিক ৩ তলা পাকা বিল্ডিং। চলাফেরায় ব্যবহার করেছেন একাধিক গাড়ি। সন্ধ্যার পর থানা পুলিশের একটি গাড়ি তার বাড়ির সামনে লাগানো থাকতো। ধরনা দিতে আসতেন ইউএনও-ওসি। আনিসুল হক মন্ত্রী হওয়ার পর স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ সব পদ দখল করে নেন স্বপন। ২০০৯ সাল থেকে কুটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির পদ সায়েদুর রহমান স্বপনের দখলে। কুটি অটল বিহারী উচ্চ বিদ্যালয় ও কুটি বাজার শিল্প বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করেন ২০১৬ সালে। ফরম ফিলাপ, ভর্তিসহ নানা খাতে কুটি বালিকা বিদ্যালয় থেকে বছরে ২০/৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এসব হিসেবপত্র রাখার জন্য বিদ্যালয়ে দুটো খাতা মেইনটেন করা হয় বলে সূত্র জানায়। অটল বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ কানি এবং বালিকা বিদ্যালয়ের ৫ কানি মোট ৯ কানি জমির মাটি ১৬ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। কিন্তু এই টাকা বিদ্যালয় ফান্ডে জমা করেননি। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থেকেও নানা প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করেন। ২০১৬ সালে কুটি বাজার শিল্প বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করে পেরীফেরী করে ১০৪টি দোকান করেন। একেকটি দোকানের জন্যে সর্বনিম্ন ১০ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেন। এমনকি অর্পিত সম্পত্তির ওপরে থাকা বাজার কমিটির অফিসের জায়গায় ৪টি দোকান ঘর করে  দেড় কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। সালিশ বিচারের নামে তার কাছে জমা হওয়া টাকাও ফেরত দেননি। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মোখলেছুর রহমান লিটন জানান, এসবের প্রতিবাদ করায় তার বিরুদ্ধে ৩টি, তার ভাই ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান বিপ্লবের বিরুদ্ধে ২টি এবং ভাগ্নে দশম শ্রেণির ছাত্র শাকিব ইসলামের বিরুদ্ধে ১টি মামলা দেন। স্বপন বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে করা মামলায় ৮৩ দিন জেল খেটেছেন তিনি। ৫ দিন রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে। 

No comments

Powered by Blogger.