কুমিল্লায় প্রকাশ্যে মহড়া দেয়া সেই অস্ত্র কোথায়?

কথায় কথায় অস্ত্রের মহড়া। কখনো নিজের দলের বিরুদ্ধে, আবার কখনো বিরোধী মত দমনে। কখনো চাঁদা না পেয়ে। আবার কখনো সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি দখলে। কুমিল্লায় আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানিতে বহুবার রক্তাক্ত করেছে কুমিল্লাকে। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের বিতর্কিত সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তার নেতাকর্মীরাই এসব অস্ত্র দিয়ে জেলা শহরটিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। হাসিনার সঙ্গে নেতাকর্মীরা পালালেও অবৈধ এ সকল অস্ত্র ও বহনকারীদের খোঁজ পায়নি পুলিশ। তাই ধারণা করা হচ্ছে, হাত বদল বা নিজেরাই এসব অস্ত্র দিয়ে যেকোনো সময় হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩রা আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব ঘোষিত গণমিছিল কর্মসূচিতে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এ সময় নিরস্ত্র ছাত্রদের মিছিলে রিভলভার, শটগানসহ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে মহানগর ছাত্র, যুব, স্বেচ্ছাসেবক ও আওয়ামী লীগ। হামলায় সরাসরি দেখা যায় মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টু, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সোহেল, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম টুটুলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। এ সময় কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় হামলাকারীরা। এতে ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়।
গত ৩০শে জানুয়ারি বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সময়ে থেমে থেমে অস্ত্রের মহড়া দেয়া হয়। কুমিল্লা নগরীতে ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসের সামনে ঘণ্টাব্যাপী আগ্নেয়াস্ত্র, রাম দা, ছেনির মহড়া, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটায়। এ সময় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হামলার অভিযোগ ওঠে। কুমিল্লা নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গোবিন্দপুর খলিফা বাড়িতে এ ঘটনা ঘটেছে। হামলার সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও দেখা গেছে অন্তত ৬ জন কিশোর-যুবক এই হামলায় অংশ নিয়েছে। সিসি ফুটেজে দেখা যায়, আগ্নেয়াস্ত্র, রামদাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুর রহমানের কার্যালয়ের সামনে মহড়া দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত। তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কাউন্সিলর অফিসের সামনে মহড়া দিচ্ছে। এ সময় তাদের কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এলোপাতাড়ি গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই হামলার ঘটনায় মামলা হলেও উল্লেখযোগ্য অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
২রা ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা নগরীর সার্কিট হাউস ও ঈদগাহ মোড় এলাকায় অস্ত্রের মহড়া দেয় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপ। উভয় গ্রুপ দেশীয় অস্ত্র ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে দুজন আহত হন। পরদিন দুই গ্রুপের ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় কিশোর অপরাধীদের রতন গ্রুপ ও ঈগল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ১০টি দেশীয় অস্ত্র ও নয়টি ককটেলসহ ১৬ জন কিশোর অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রতন গ্রুপ ও ঈগল গ্রুপ আধিপত্য বিস্তার করতে সংঘাতে জড়ায়। ২০২২ সালের ৭ই নভেম্বর কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ও অস্ত্রের মহড়ায় পিস্তল ও রাইফেল হাতে প্রতিপক্ষকে হামলা করতে দেখা যায়। অস্ত্র হাতে ১৫-১৬ জন ছিলেন সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সমর্থক ও সম্মেলনের কার্ডধারী। নগরীর কান্দিরপাড় ও নজরুল অ্যাভিনিউতে এই ঘটনা ঘটে।
সম্মেলনস্থলের বাইরে আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি ও আঞ্জুম সুলতানা সীমা এমপির লোকজনের মাঝে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় অস্ত্র হাতে মহড়া দেয়া দুটি ছবিতে দেখা যায়, লাল মাস্ক পরে অস্ত্র হাতে সামনের দিকে তেড়ে আসছেন এক যুবক। ওই যুবকের নাম দিদারুল হক আশিক। তার বাড়ি নগরীর চর্থা এলাকায়। আরেক ছবিতে দেখা যায়, ক্যাপ পরা এক যুবক রাইফেল প্রস্তুত করছেন। ওই যুবকের নাম দিদার। তার বাড়ি নগরীর টমছম ব্রিজ এলাকায়। ওই যুবকের পাশেই আশিক ও বাপ্পী নামের দুজনকে দেখা যায়। তাদের বাড়িও নগরীর চর্থা এলাকায়। অস্ত্রধারী অনেকের মাথায় হেলমেট ছিল। কেউ কেউ মুখে কাপড় বেঁধে আসেন। কেউ কাঁধে ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট বহনকারী ব্যাগে ঝুলিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসেন।
২০২১ সালের ২২শে নভেম্বর নগরীর পাথরিয়াপাড়া থ্রি স্টার এন্টারপ্রাইজে কাউন্সিলর কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন তৎকালীন কাউন্সিলর ৫০ বছর বয়সী সোহেল ও তার সহযোগী হরিপদ সাহা। এ ঘটনায় কুমিল্লার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। সোহেল কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আর হরিপদ সাহা (৫৫) নগরীর ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সাহাপাড়া এলাকার বাসিন্দা। জোড়া খুনের ঘটনার পরদিন ২৩শে নভেম্বর রাতে কাউন্সিলর সোহেলের ছোট ভাই সৈয়দ মো. রুমন বাদী হয়ে ১১ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৮ থেকে ১০ জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। এরপর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন, মামলার প্রধান আসামি শাহ আলম, তিন নম্বর আসামি সাব্বির ও পাঁচ নম্বর আসামি মো. সাজন।
আলোচিত এই জোড়া খুনের ঘটনার শুরু থেকেই নিহত সোহেলের পরিবারের সদস্যরা বলে আসছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইন্ধন দিয়ে এবং অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিয়ে হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করিয়েছে। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, আলোচিত একটি অপরাধ ধামাচাপা দিতেই কাউন্সিলর সোহেলকে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহার জড়িত রয়েছেন বলেও শোনা যায়। এ ছাড়াও কয়েক বছরে বিচ্ছন্ন অর্ধশত ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও মহড়ার ঘটনা ঘটে। কিছু ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ বিভিন্ন সময় অস্ত্র উদ্ধার করে। সেইসঙ্গে অপরাধীও গ্রেপ্তার করে। তবে তা সংখ্যায় অনেক কম।
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ই আগস্ট কুমিল্লার কয়েকটি থানা ও পুলিশ লাইন্সে হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়। এ সময় ৫২ অস্ত্র লুট হয়েছিল। এরমাঝে ৩০টি উদ্ধার করা হলেও ২২টি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়াও বৈধ লাইসেন্সধারী ১৬২টি অস্ত্র জমা হলেও বাকি আছে আরও ৩৫০টি বৈধ অস্ত্র। কিন্তু নানান সময় মহড়া দেয়া অবৈধ  অস্ত্রের কোনো সংখ্যা বা এই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে একটি সূত্রে বলছে, এসব অস্ত্র উদ্ধারে গোয়েন্দা নজরদারি ও জেলা পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) খন্দকার আশফাকুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন থানা থেকে লুট হয়েছে পুলিশের অস্ত্র। আমরা বেশির ভাগ অস্ত্রই উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। এর আগেও জেলা পুলিশ বিভিন্ন সময় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। আশা করছি অভিযানে ভালো সুফল আসবে।

No comments

Powered by Blogger.