সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ: নেতানিয়াহু চরম বিপাকে! by মাহবুব নাহিদ

নেতানিয়াহুর উপরে ভরসা নেই বাইডেন প্রশাসনের। অর্থাৎ নানামুখী সংকট কিন্তু চেপে ধরেছে নেতানিয়াহু সরকারকে। যেদিকেই যায় সাগর ফুরিয়ে যায়- এমন একটা অবস্থা। আর হামাস এখন একা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না। ইরান একদম স্পষ্ট সহায়তা করছে হামাসের সঙ্গে। এই জায়গায়ও ব্যর্থ নেতানিয়াহু তথা ইসরাইল। কারণ ফিলিস্তিন একটা সুন্নি দেশ, হামাস সুন্নিদের সংগঠন কিন্তু ইরান শিয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্বস্থানীয় দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা কীভাবে হামাসের পাশে দাঁড়ায়।

এটা না বুঝতে পারা কিংবা যেভাবে সুন্নিদের বড় বড় রাষ্ট্র বিশেষভাবে বললে সৌদি আরবকে চুপ রাখা গেছে, সেই জায়গা থেকে ইরান দাঁড়িয়ে যাবে সেটা তো ভাবতে পারেনি নেতানিয়াহু। কিন্তু এটা ভাবা উচিত ছিল...

জ  ন্ম থেকেই যাদের যুদ্ধ চলছে, ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে একটা ভুলের মধ্যদিয়ে। একটা ভুল বললে ভুল হবে শত শত ভুলের একটা বাজে ফলাফল ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মধ্যে ইসরাইল গঠন করা। সেই থেকে যে যুদ্ধ চলছে সেই যুদ্ধ আর থামছে না, থামে অবশ্য মাঝে মধ্যেই, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। থেমে গিয়ে আবার শুরু হয়, শুরু হলে আর থামে না।
গত ১১ মাস ধরে যুদ্ধ চলছে হামাস এবং ইসরাইলী বাহিনীর মধ্যে। কিন্তু এবার যুদ্ধবিরতির একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা আসলে ভিন্ন দিক থেকে আসছে। এবার যুদ্ধ বিরতি চাচ্ছে ইসরাইলের মানুষ। অন্যদিকে হামাস মনে করছে যুদ্ধবিরতির কোনো প্রয়োজন নাই। কিছুদিন আগেই হামাস প্রধানকে হত্যা করা হয়। নিহত হন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এসব ঘটনা হামাসকে কোণঠাসা করলেও পিছপা হয়নি হামাস, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সাহস এবং শক্তি দুটোই দেখাচ্ছে তারা।

কিন্তু ইসরাইলের মানুষ কেন যুদ্ধবিরতি চাইছে? তাহলে কি তাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে যেতে চাইছে? তাদের উদ্দেশ্য কি ভুলে গেছে তারা? ইহুদি জাতির ইতিহাস আমরা সবাই জানি। জার্মানির চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার ইহুদিদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। একপর্যায়ে যুদ্ধ জিতেও যেতে পারতো হিটলার বাহিনী। কিন্তু উল্টো পরাজয় বরণ করতে হয় তাকে। কিন্তু যুদ্ধে ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশি হয়ে যায় ফিলিস্তিনের। উদ্বাস্তুর মতো ইহুদিদের পাঠানো হয় ফিলিস্তিনে, সেখানে একটা রাষ্ট্র গঠন হয় ইসরাইল। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের একটা বড় উদ্দেশ্য আছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে তারা সারা বিশ্ব শাসন করবে। সেই সারা বিশ্বকে শাসন করতে হলে তাদেরকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। শর্তগুলো হচ্ছে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন জায়গায় যত ইহুদি আছে সবাইকে এক জায়গায় আসতে হবে, গঠন করতে হবে একটা নিজস্ব রাষ্ট্র। এরপর তাদের একজন মাসিহ বা ত্রাণকর্তা আসবে যে কিনা তাদেরকে নেতৃত্ব দেবে, যাকে আমরা দাজ্জাল হিসেবে জানি। তার আগে তাদেরকে ভাঙতে হবে আল আক্‌সা মসজিদ, যেটা ভেঙে বানাতে হবে থার্ড টেম্পল বা কিং সালমানের মন্দির। এখন সেই মন্দির ভাঙার আগে তাদেরকে আবার পবিত্র হতে হবে। পবিত্র হওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে এক তরল পদার্থের যা পাওয়া যাবে লাল এক ধরনের গরু থেকে।

এত কথা বলার কারণ আছে। সারা বিশ্ব শাসন করাই যদি মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে এত সহজেই তারা যুদ্ধবিরতি চাইছে কেন? যুদ্ধবিরতি কারা চাইছে সেটা আগে দেখার বিষয়। যুদ্ধবিরতি চাইছে ইসরাইলের সাধারণ মানুষ। তার মানে নেতানিয়াহু সরকার অবশ্যই তাদের মূল যে উদ্দেশ্য আছে সেটাকে দেশের মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারেন নাই। সেটাই যদি পারতেন তাহলে ইসরাইলের মানুষ কেন রাস্তায় নেমে আসবে!

মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে অবশ্য বিশেষ একটা কারণে। গত শনিবার গাজায় ইসরাইলের ৬ জিম্মির মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ইসরাইলের সাধারণ মানুষ। ইসরাইলের ট্রেড ইউনিয়ন হিস্ট্রড্রট ধর্মঘটও পালন করে। ধর্মঘটের ফলে দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় সকল কল কারখানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জিম্মিদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে না পারায়, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ক্ষমা চেয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। পুরো ঘটনার জন্য হামাসকেই সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু নেতানিয়াহুর অপারগতাও অস্বীকার করতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে নেতানিয়াহু যথেষ্ট উদ্যোগ নিতে পারেনি বলে মনে করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুদ্ধবিরতি বিষয়েও চাপ দিতে থাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জিম্মিদের মুক্ত করতে না পারায় এত চটে যাওয়ার পিছনে অবশ্য কারণ আছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের। গত শনিবার নিহত হওয়া ৬ জিম্মির মধ্যে একজন যে মার্কিন নাগরিক ছিল, তাই তো এত জোর তাদের! অর্থাৎ দেশটা ইসরাইলের হলেও চালায় যে আমেরিকা তা বুঝতে খুব একটা বুদ্ধিমান হওয়া লাগে না। তাদের নাগরিককে মুক্ত করতে পারে নাই বলে দেশে ধর্মঘট লাগিয়ে দিয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমা পাওয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছে তারা। সিলেবাসের বাহিরে প্রশ্ন আসলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। এদিকে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি উল্লেখ করে ইতিমধ্যেই দেশটির কাছে বেশকিছু অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
যুদ্ধ যেমন দুইদিক থেকে হয় তেমনি যুদ্ধ বিরতি হলেও তো দুই দিক থেকেই হবে। হামলা দুইদিক থেকে হবে, মানুষ দুইদিকেই মারা যাবে। হামাসের বক্তব্য হচ্ছে- যদি ইসরাইল গাজায় অভিযান চালায় তাহলে জিম্মিরাও মুক্তি পাবে না। ইসরাইল যুদ্ধের নাম করেই বিভিন্ন জায়গায় দখল শুরু করেছে ইসরাইল। জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে দর্শনীয় একটি এলাকা হলো ফিলিস্তিনের বাত্তির। সেখানকার জলপাই বাগান এবং আঙ্গুরক্ষেতের জন্য পরিচিত এই গ্রাম। এখানে প্রাকৃতিক ঝরনার জল ব্যবহার করা হয় সেচের কাজে। কয়েক শতাব্দী ধরে এইভাবেই জীবন বয়ে চলেছে সেখানে।
প্রকৃতির কোলঘেঁষা এই গ্রামই অধিকৃত ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’ বা পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের সর্বশেষ ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’-এ পরিণত হয়েছে।

ইসরাইল এখানে একটা নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন বা ‘সেটলমেন্ট’-এর অনুমোদন দিয়েছে। এই নতুন বসতির জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে বহু মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি। শুধু তাই নয়, অনুমোদন ছাড়াই নতুন ইসরাইলি ফাঁড়িও স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থাৎ হিসাব খুবই পরিষ্কার, কাজ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। মানে ইসরাইলের কথা বলছি। তারা আস্তে আস্তে পুরো ফিলিস্তিন দখল করবে, এক সময় গাজা দখল করবে, আল আক্‌সা মসজিদ তাদের নিজেদের করে নেবে, এটাই তাদের ইচ্ছা বা স্বপ্ন। সব স্বপ্নই যে সবসময় বাস্তবে রূপান্তরিত হবে তা তো সত্যি নয়। আল আক্‌সা শুধু ফিলিস্তিনের মানুষের আবেগের জায়গা নয়, আল আক্‌সা সারা বিশ্বের মুসলমানদের আবেগ অনুভূতির জায়গা। এই মসজিদ মুসলমানদের কিবলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই মসজিদ মহানবী (সঃ)কে মিরাজের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে এই মসজিদ সকল মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর উপরে হাত দিতে আসলে একটা বড় সংঘর্ষের দিকে আগাবে।

ভারতের বেশ কয়েকজন সাবেক আমলা, সমাজকর্মী এবং খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ইসরাইলে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন কোম্পানিকে দেয়া লাইসেন্স বাতিল এবং নতুন লাইসেন্স দেয়া বন্ধের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন। আমেরিকার পাশাপাশি ভারতও ইসরাইলের একটা মিত্র শক্তি। ভারতের নির্বাচন ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। সেখানে ইসরাইলের বন্ধুপ্রতিম শক্তি বিজেপি তথা মোদী পুনরায় ক্ষমতা পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে আমেরিকা নিয়ে। একে তো সামনে আমেরিকার নির্বাচন। অন্যদিকে আমেরিকাতেও সাধারণ মানুষ ফিলিস্তিনের উপর নির্যাতন বন্ধের জন্য সোচ্চার। আমেরিকাতেও বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে মানুষ আন্দোলন করে যাচ্ছে, প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। জার্মানিতে একটা অনুষ্ঠানে হিলারি ক্লিনটনকে একদম জনসমক্ষে যাচ্ছেতাই অবস্থা করে দেয়া হয় ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে। আমেরিকাতে বর্তমানে ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় আছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। ডেমোক্রেটরা এবার প্রার্থী হিসেবে পাচ্ছেন কমলা হ্যারিসকে। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে, এবার রিপাবলিকান পার্টির ডনাল্ড টাম্পেরও যথেষ্ট এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। আর সেটা হলে ইসরাইলের উপর সুনজর সরেও যেতে পারে আমেরিকার। অন্যদিকে নেতানিয়াহুর উপরে ভরসা নেই বাইডেন প্রশাসনের। অর্থাৎ নানামুখী সংকট কিন্তু চেপে ধরেছে নেতানিয়াহু সরকারকে। যেদিকেই যায় সাগর ফুরিয়ে যায় এমন একটা অবস্থা। আর হামাস এখন একা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না। ইরান একদম স্পষ্ট সহায়তা করছে হামাসের সঙ্গে। এই জায়গায়ও ব্যর্থ নেতানিয়াহু তথা ইসরাইল। কারণ ফিলিস্তিন একটা সুন্নি দেশ, হামাস সুন্নিদের সংগঠন কিন্তু ইরান শিয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্বস্থানীয় দেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা কীভাবে হামাসের পাশে দাঁড়ায়। এটা না বুঝতে পারা কিংবা যেভাবে সুন্নিদের বড় বড় রাষ্ট্র বিশেষভাবে বললে সৌদি আরবকে চুপ রাখা গেছে, সেই জায়গা থেকে ইরান দাঁড়িয়ে যাবে সেটা তো ভাবতে পারেনি নেতানিয়াহু। কিন্তু এটা ভাবা উচিত ছিল।

এখন কথা হচ্ছে, এই যে একটা বৈশ্বিক সংকট। এটা কি শুধুই হামাস আর ইসরাইলের লড়াই। এর মধ্যে কী আর কারও কিছুই নেই? জাতিসংঘ থেকে শুরু করে অন্যান্য সংগঠন কেন চুপচাপ বসে আছে! যতদিন সারা পৃথিবী এই সমস্যাকে বৈশ্বিক সমস্যা মনে না করবে, যতদিন সবাই এটাকে নিজেদের সমস্যা না মনে করবে ততদিন এর সমাধান হবে না। আসলে সবাই মিলে মজা দেখছে, এই মজা দেখা বন্ধ না হলে যুদ্ধও শেষ হবে না। যেভাবে ফিলিস্তিনের মানুষকে নির্বিচারে মারা হচ্ছে তা মানার মতো না। আবার ইসরাইলের যে কেউ মারা যাচ্ছে না, তাও তো না, যুদ্ধ হলেও খতিগ্রস্ত সবাই হবে। কিন্তু এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসার সমাধান খুঁজতে হবে। যুদ্ধবিরতি কোনো সমাধান হতে পারে না, প্রয়োজন যুদ্ধ বন্ধের।

No comments

Powered by Blogger.