শহীদদের গল্প: বাবার মৃত্যুর পর সংসারের ভরসা ছিল শাকিল by ফাহিমা আক্তার সুমি

শাকিল হোসাইন। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। চারুকলা বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। গত ৪ঠা আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হন। নিউরোসাইন্স হাসপাতালে ৩ দিন আইসিইউ’তে থাকার পর মারা যান তিনি। শাকিলের গ্রামের বাড়ি ভোলায়। বেশ কয়েক বছর আগে নদীতে ভেঙে যায় তাদের বসতভিটা। এরপর শাকিলের বাবা-মা কাজের সন্ধানে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আসার ৬ মাস পরে শাকিলের বাবা সিদ্দিক মৃধা অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান। শাকিলের মা বাসা-বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। গত ৬ মাস ধরে অসুস্থতার কারণে আর কাজে যেতে পারেন না। শাকিল পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে খরচ জোগাতেন। তার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে পরিবারটি।

শাকিলের মা বিবি আয়েশা মানবজমিনকে বলেন, আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। সংসারে অভাব থাকায় অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। দুই ছেলের মধ্যে শাকিল ছিল বড়। সংসারের সব দায়িত্ব তারই ছিল। ওদের বাবা ২০১৪ সালে অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যায়। সে নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করতো। আমি আগে বাসা-বাড়ির কাজ করতাম। এখন শরীরের নানা রোগের কারণে কোনো ভারী কাজ করতে পারি না। ছোট ছেলে সুমনকে বেশিদূর পড়াশোনা করাতে পারিনি। সে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে। শাকিল আমাকে কাজ করতে নিষেধ করেছিল। ও বলেছিল, ‘মা তুমি কাজে আর যেও না, আমি সব দেখবো।’ শাকিল বাচ্চাদের ক্লাস নিতো, কয়েকটি টিউশনি করাতো, যখন অবসর সময় পেতো তখন ইলেক্ট্রিকের কাজ করতো। সবসময় চাইতো কি করে আমাদের ভালো রাখা যায়। আমাকে ও আমার ছোট ছেলেটাকে নিজের কষ্ট হলেও সবসময় আগলে রাখতো।

গতকাল মিরপুরের পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, চলতি মাসেই তারা এক রুমের একটি নতুন বাসায় উঠেছেন। এই বাসায় আগের চেয়ে ভাড়া কম। ছোট এক রুমের বাসাটিতে অসহায়ের মতো বসে আছেন শাকিলের মা। বলেন, আমার সন্তান মারা যাওয়ার পরে আগের বাসা ছেড়ে দিয়েছি। আগে ৭ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়া থাকতাম। এখন সাড়ে ৪ হাজার টাকা দেই। আমার পুত কাজ-কাম করবে আমারে খাওয়াবে, আমি মরলে মাটি দিবে সেই ছেলেরেই আল্লায় নিয়ে গেছে, এখন কি আর আমার কিছু আছে। ওর খুব পড়াশোনা এবং কাজের দিকে আগ্রহ ছিল আমাদের ভালো রাখার জন্য। আমার ছোট ছেলেটার বয়স খুব কম। ও মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন পায়। এখন কীভাবে সংসার চালাবো বুঝতে পারছি না।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার সন্তান রাতে বাসায় ফিরতো। রাত আসলেই আমি আর ঘুমাতে পারি না। কোনোদিন একটু মাথা ব্যথা করছে শুনলে ও পাগল হয়ে যেতো। টেনশন করতো ওর ভাইকে কীভাবে রাখবে, আমাকে কীভাবে রাখবে। আগে নিজে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছি, কিন্তু এখন তো সেই শক্তি নেই। যা শক্তি ছিল ছেলের মৃত্যুতে তাও হারিয়েছি। দুই মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকে। সবাই এসে দেখে যায় আমার কষ্ট বোঝার মতো কেউ নেই। আমার মতো কতো মায়ের বুক খালি হয়েছে। কতো মা আমার মতো কেঁদে রাত-দিন পার করছে।

তিনি বলেন, গত ৪ঠা আগস্ট রোববার আমার ছেলেকে নতুন বাসা দেখার জন্য কল দিয়েছিলাম। এরপর বাসায় এসে দুপুরে খাবার খেয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিল। এরমধ্যে ওর মোবাইলে একজন কল দিলে কিছুক্ষণ পরে উঠে যায়। পরে একটার দিকে ওর কিছু বন্ধু আমাদের বাসায় এসে বলে আন্টি আপনার আমাদের সঙ্গে যেতে হবে শাকিল ভাইয়া একটু অসুস্থ তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাকে অভিভাবক ছাড়া চিকিৎসা করবে না। পরে শুনি কুর্মিটোলা হাসপাতালে রাখেনি আগারগাঁও নিউরোসাইন্স হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। পরে আমরা একটি সিএনজি নিয়ে আগারগাঁও গিয়েছি। আমার শাকিলের মাথায় গুলি লাগে দুইটা। একটা ভিতরে ছিল আরেকটি বের হয়েছিল। তিন রাত চার দিন লাইফ সাপোর্টে ছিল। গত ৭ই আগস্ট নিউরোসাইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। শুরু থেকে আন্দোলনে ছিল শাকিল। ৮ তারিখে ভোলায় নিয়ে দাফন করা হয় শাকিলকে। আমার একটাই চাওয়া আমার সন্তান হত্যার বিচার যেন আমি পাই। আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে এই মর্যাদাটা যেন পাই। সরকার যেন আমার সন্তানটিকে মনে রাখে।

No comments

Powered by Blogger.