তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করতে হবে -অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস
এমনকি পানির পরিমাণ নিয়ে যদি আমি খুশি নাও হই, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। এই বিষয়টি সমাধান হতেই হবে। দ্রুত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির জন্য ভারতকে অন্তর্বর্তী সরকার চাপ দেবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘চাপ একটি বড় শব্দ। আমি এটা বলছি না। তবে আমাদের একসঙ্গে বসে সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, এটা নতুন কোনো সমস্যা নয়, অনেক পুরনো সমস্যা। এ বিষয়ে আমরা একাধিকবার কথা বলেছি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় পাকিস্তান আমলে। আমরা সবাই চেয়েছিলাম এই চুক্তি হোক, এমনকি ভারত সরকারও এর জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমাদের এটি সমাধান করতে হবে। সমপ্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে ঢাকার গণমাধ্যমের খবরের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের সংকটে আমরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একসঙ্গে কাজ করে এর সমাধান করতে পারি।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বগ্রহণ করার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা সাক্ষাৎ করেন। বিষয়টি তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভারতের হাইকমিশনার যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আমি বলেছি যে কীভাবে বন্যা মোকাবিলা করা যায় সে ব্যাপারে আমরা আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারি। দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের সমন্বয়ের জন্য কোনো চুক্তিরও প্রয়োজন নেই। মানবিক দিক বিবেচনা করেই এই সমস্যা সমাধানে আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। কেননা, এটি গণমানুষের দুর্দশা লাঘব করবে। এ ধরনের মানবিক পদক্ষেপ সত্যিকার অর্থেই সহায়তা করবে। সীমান্ত হত্যার নিন্দা জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, হত্যাকাণ্ড কোনো সমাধান নয়। কাউকে হত্যা করা কোনো সমাধান নয় কারণ এটি মোকাবিলার আইনি উপায় রয়েছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সীমান্ত হত্যা একতরফা ব্যাপার। আপনার দেশ দখলের জন্য কেউ সীমান্ত অতিক্রম করছে না। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। এছাড়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) চেতনার পুনরুজ্জীবন হওয়া দরকার বলে মনে করেন ড. ইউনূস। পিটিআই’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আটটি দেশের এ জোট আঞ্চলিক অনেক সমস্যার সমাধানে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। একটি মহৎ উদ্দেশ্যে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি এখন শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, এর কোনো দৃশ্যমান কার্যকারিতা নেই। দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশ নিয়ে গঠিত এই সংস্থার সদস্য দেশগুলো হচ্ছে- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান। ড. ইউনূস বলেছেন, তিনি এই মাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সার্বিক বিষয়ে আলাপ করার চেষ্টা করবেন। তিনি সার্কভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের একত্র করার চেষ্টা করবেন বলেও উল্লেখ করেন। পিটিআই’কে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন অবশ্যই, আমরা (প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির) সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবো।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর সব রাষ্ট্রপ্রধান একত্রিত হয়ে একটি ছবি তোলার চেষ্টা করবো। সার্ক একটি মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য গঠিত হয়েছিল। এটি এখন কেবল কাগজে-কলমে বিদ্যমান। আমরা সার্কের নাম ভুলে গেছি, আমি সার্কের চেতনা পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছি। জাতিসংঘ কর্তৃক জারি করা বক্তাদের একটি অস্থায়ী তালিকা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী মোদির ২৬শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে। সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশন ২৪শে সেপ্টেম্বর শুরু হবে। চলবে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ইউনূস বলেন, অনেকদিন সার্ক সম্মেলন হচ্ছে না। আমরা যদি একত্র হই তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। আঞ্চলিক এই সংস্থাকে সক্রিয় করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নেপাল, যা ২০১৬ সালের পর থেকে খুব একটা কার্যকর নয়। সে বছর সার্কের শীর্ষ সম্মেলন ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই বছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে ভারতীয় সেনা ক্যাম্পে ‘সন্ত্রাসী’ হামলার পর, ভারত বিরাজমান পরিস্থিতিতে শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। বাংলাদেশ, ভুটান এবং আফগানিস্তানও ইসলামাবাদ বৈঠকে অংশ নিতে অস্বীকার করার পরে শীর্ষ সম্মেলনটি স্থগিত করা হয়েছিল। নোবেলজয়ী ইউনূস উল্লেখ করেছেন যে, সার্কের মতো আঞ্চলিক স্বার্থে গঠিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যদিও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অনেক কিছু অর্জন করেছে, সেক্ষেত্রে সার্ক এখনও তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের দেশগুলো অনেক কিছু অর্জন করেছে। ড. ইউনূস বলেছেন- সার্ক যাতে কাজ করে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে তাকান এবং এটি কতটা উজ্জ্বলভাবে কাজ করছে। পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো সমস্যা হলে, অন্য উপায়ে কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু সার্কের কার্যক্রম বন্ধ করা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি।
২০১৬ সালের পর থেকে সংস্থাটি কার্যকর নয় কারণ ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে যে দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল তা অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ইউনূস বলেছিলেন যে, তিনি মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে রাজি করার জন্য ভারতের সঙ্গে কাজ করবেন। ড. ইউনূস আরও বলেন, সংকট মোকাবিলায় ঢাকার ভারত ও চীন উভয়ের সহায়তাই প্রয়োজন। রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের জন্য আমাদের ভারত ও চীনের সাহায্য দরকার। প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। কিছু এ পর্যন্ত যারা মিয়ানমারে ফিরে গেছে তাদের সংখ্যা খুব সামান্য। ভারতের মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে রাজি করাতে বাংলাদেশের ভারতের সাহায্য প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন ড. ইউনূস। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নৃশংস সামরিক দমন-পীড়নের পর ২০১৭ সালে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল, যা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা জাতিগত নিধন হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মূলত তাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত।
No comments