২০১২ : ফিরে দেখা ২০১৩ : সম্ভাবনা ও সংকট by ড. মীজানূর রহমান শেলী

খ্রিস্টীয় বর্ষ শুরুর মাস জানুয়ারির নাম রাখা হয় কল্পকাহিনীর দেবতা 'জ্যানাস'-এর নামানুসারে। বলা হয়, জ্যানাসের মুখমণ্ডল দুটি, একটি ফিরে থাকে পেছনের দিকে, আরেকটি চেয়ে থাকে সামনের দিকে।
আধুনিক বিশ্বে তাই জানুয়ারি একদিকে যেমন সালতামামির সময়, অন্যদিকে তেমনি নতুন বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে চিন্তাভাবনার কাল। সেই ধারাবাহিকতায়ই আমরা শুরুতে পর্যালোচনা করি গত বছরের নানা ঘটনার কথা এবং তার ভিত্তিতে গড়ে তুলি নতুন বছরের গতি-প্রকৃতির রূপরেখা।
সারা বিশ্বের জন্য যেমনি, তেমনি বাংলাদেশের জন্যও ২০১২ ছিল আশা-নিরাশা এবং সম্ভাবনা ও সমস্যার মিশ্র অভিজ্ঞতার কাল। এ বছরটি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সশস্ত্র সংঘাত এবং মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যা ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের বিবাদ ও সংঘাত আরো জটিল রূপ নেয়। সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ কেড়ে নেয় হাজার হাজার নিরীহ নাগরিকের প্রাণ, আহত ও বাস্তুচ্যুত করে লাখ লাখ মানুষকে। মার্কিন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দখলদার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও ইরাকে শান্তি ও স্থিতি ফিরে আসেনি, বরং শিয়া-সুন্নি বিরোধ ও সংঘাত নিয়েছে সাম্প্রদায়িক হানাহানির রূপ। প্রায় একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে আফগানিস্তানে। এখানে আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও কট্টরপন্থী তালেবানদের হামলা দেশটির শান্তি ও উন্নয়নকে মারাত্মক বিঘ্নিত করে চলছে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলেও আন্তরাষ্ট্রীয় বৈরিতা ও দ্বন্দ্ব পুরো এলাকাটিকেই অনিশ্চিতের জালে আবদ্ধ রেখেছে। উত্তর কোরিয়ার বিকাশমান পারমাণবিক শক্তি আশপাশের দেশগুলোতে দারুণ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা দুনিয়ার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের সশস্ত্র প্রয়াস মুসলিম বিশ্ব এবং পাশ্চাত্যকে বৈরী হিসেবে মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে প্রবল করে চলছে।
অন্যদিকে ২০০৭-২০০৮ সাল থেকে চলে আসা পাশ্চাত্যের আর্থিক ধস এবং বিশ্বমন্দার নেতিবাচক প্রভাব এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ইউরোপের ইউরো জোন বা অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশগুলোর কয়েকটি প্রায় দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। এর মধ্যে গ্রিস, পর্তুগাল, স্পেন ও ইতালি অন্যতম। এসব দেশে তো বটেই, এমনকি পুঁজিবাদের কেন্দ্রভূমি সমৃদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেকার মানুষের কাতার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠছে। হাজারো রাষ্ট্রীয় প্রয়াস সত্ত্বেও মন্দার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমছে না।
বাংলাদেশে বিগত বছরটি ছিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বিবাদে উত্তপ্ত। ক্ষমতাসীন দল উচ্চ আদালতের এক রায়ের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে। সরকারি দলের কর্তৃত্বে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা বিরোধী দল ও তার মিত্ররা মানতে রাজি নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের আপসহীন দাবি নিয়ে তারা গড়ে তোলে বিরামহীন আন্দোলন, যা বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে আরো প্রবল ও ব্যাপক রূপ নেয়। সরকার প্রশাসন ও দলীয় সংগঠনগুলো ব্যবহার করে এই আন্দোলন প্রতিরোধে সক্রিয় রয়েছে। আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে এই প্রশ্নের নিষ্পত্তির কথা সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলো বারবার উচ্চারণ করা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের আশু সম্ভাবনা দেখা যায় না। তাই প্রশ্ন জাগে যে ২০১৩ সালে এই বিবাদ-বিসংবাদ আরো বাড়বে কি এবং ব্যাপক সহিংসতা দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলাকে আরো বিশাল মাত্রা দেবে কি?
এরই মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদে মগ্ন দলগুলো দেশে উদ্বেগাকুল পরিস্থিতির সূচনা করেছে। ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধ পালনকালে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কিছু সদস্য পুরান ঢাকায় সর্বসম্মুখে নিরীহ এক অরাজনৈতিক দরিদ্র তরুণ বিশ্বজিৎ দাসকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফলে দেশব্যাপী শোক এবং প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। সরকার কিছু বিলম্বে হলেও এই দুর্বৃত্তদের অনেককেই গ্রেপ্তার করে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন হবে। বিশ্বজিৎ হত্যা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সংঘাতের যেমন, তেমনি দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, কলহ ও সহিংসতার ফলে আগের বছরগুলোর মতোই ২০১২ সালেও বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার।
নভেম্বরে কঙ্বাজার জেলার রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা, লুটপাট ও অগি্নসংযোগসহ বহু বৌদ্ধ পরিবারকে ভীতসন্ত্রস্ত ও বাস্তুহারা করা হয়। সেই সঙ্গে কালিমালিপ্ত হয় বাংলাদেশের শত শত বছরের অসাম্প্রদায়িক জীবনধারা ও চেতনা। এ ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর শ্লথতা ও শৈথিল্য এবং দেশের সুশাসনের অভাবের নজির বলেই অনেকে মনে করেন। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধী ও উসকানিদাতাদের গ্রেপ্তার, বিচার ও কঠোর শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে না। প্রশাসনিক শৈথিল্য এবং সুশাসনের ঘাটতি অন্যান্য সহিংসতার ঘটনায়ও প্রকট হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি। সঠিক তদন্ত ও সুবিচারের দাবিতে দলমত- নির্বিশেষে সারা দেশের সাংবাদিক সমাজ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৩ সালেও তদন্তের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হলে এ বিষয়ে আরো জটিলতা সৃষ্টি হবে। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতা এবং শ্রমিক নেতা আমিরুল ইসলাম গুম হওয়ার ঘটনারও সুরাহা হয়নি। সরকারের আশ্বাস সত্ত্বেও শত শত নিখোঁজ নাগরিকের পরিণতির সন্ধান মেলেনি।
আবার নভেম্বর মাসে আশুলিয়ার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় এক মারাত্মক অগি্নকাণ্ডে নিহত হয় শতাধিক শ্রমিক। দ্রুত আগুন নেভানোর ব্যবস্থার অভাব এবং অবরুদ্ধ শ্রমিকদের কারখানার বাইরে গিয়ে প্রাণ বাঁচানোর পথ অপ্রতুল হওয়ায় এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সৃষ্টি হয় বিপুল উদ্বেগ। এর ফলে রপ্তানিমুখী এই শিল্প-কারখানাগুলোর শ্রমিক নিরাপত্তাব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি না করা হলে বিদেশে পোশাক রপ্তানি ব্যাপক বিঘ্নিত হতে পারে। সুশাসনের ঘাটতির সঙ্গে ছায়ার মতো চলে দুর্নীতি। পদ্মা সেতুর বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগে গত জুন মাসের শেষদিকে বিশ্বব্যাংক এই মহাপ্রকল্পে তার ওয়াদাকৃত ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে। পরে শর্তাধীনে ঋণ পুনঃ অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে জানালেও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে এবং অন্যান্য ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট কি না তা নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় রয়েই গেছে।
আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ভাষ্য অনুযায়ী দেশে দুর্নীতির আনুপাতিক হার কিছুটা কমলেও এর মাধ্যমে আদান-প্রদানকৃত অর্থের পরিমাণ গত বছর প্রায় দ্বিগুণে দাঁড়িয়েছে, যা জাতীয় বাজেটের ১৩ শতাংশ। ডেসটিনিগোষ্ঠী ও হলমার্ক কম্পানির জনগণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি এই সম্প্রসারমাণ দুর্নীতির জ্বলন্ত নিদর্শন।
এ ছাড়া ২০১২ সালের প্রথম থেকেই পুঁজিবাজারে যে ভয়াবহ দরপতন ঘটে, তাতে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মধ্যম শ্রেণীর বিনিয়োগকারী। সরকার নিয়োজিত তদন্ত কমিটি এই কেলেঙ্কারির পেছনে যে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে জড়িত বলে চিহ্নিত করে, তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা এ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। তাই সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, সমস্যার মূলোৎপাটন করতে না পারলে নতুন নতুন আইন ও বিধিবিধান রচনা ও প্রয়োগ কোনো কাজে আসবে না। কেন্দ্রীয় সমস্যা নিরসন করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী পরিবর্তনেও কোনো লাভ হবে না।
এত কিছুর পরেও বিশ্বমন্দার নিরাশাজনক পরিবেশে বাংলাদেশ রপ্তানি আয় অর্জন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভের হার ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্তরে, প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক সুশাসনের মাধ্যমে এই প্রবৃদ্ধির প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখলে দেশ সেই কাঙ্ক্ষিত উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভ করবে, যা সম্প্রতি বিলাতের গার্ডিয়ান পত্রিকায় আশা করা হয়েছে। তাদের পর্যালোচনা অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে অনেক ইউরোপীয় দেশকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে প্রথমে সবচেয়ে প্রয়োজন স্থিতিশীল ও অর্থবহ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। এ কাজের প্রধান দায়িত্ব বর্তায় রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলোর ওপর। তাঁরাই দেশের অস্থির ও সংঘর্ষমূলক রাজনীতির অবসান ঘটাতে পারেন- শুধু দরকার শুভবুদ্ধি ও দৃঢ় ইচ্ছার।
তাঁরা সফল হলে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের অপরিমেয় শক্তি ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্রে তরুণ খেলোয়াড়রা বাংলাদেশের জন্য একটি প্রশংসনীয় অবস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে। সঠিক পথে পরিচালিত হলে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা ২০১৩ সাল থেকেই শুরু করতে পারে দেশের সার্বিক ধারাবাহিক বিকাশ ও উন্নতির কাঙ্ক্ষিত প্রক্রিয়া।

লেখক : চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিডিআরবি) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আর্থ-সামাজিক ত্রৈমাসিক 'এশিয়ান অ্যাফেয়ার্সের' সম্পাদক
mrshelley43@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.