আলোচিত লেখক আলোচিত বই by নুরুল করিম নাসিম

গত বছর যে বইগুলো আলোচিত হয়েছে, তা এ বছরও পাঠকপ্রিয়তা পাবে- এটাই স্বাভাবিক। আসলে গতকালের বই, আজকেও বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে আমরা পড়ি। আজকের বই কি আগামীকাল পাঠ করা হবে না? বইয়ের কোনো দিনকাল নেই। বইয়ের কোনো দেশ নেই।
ভাষার অর্গল উঠিয়ে দিলে আর যে ভাষায় এ বইটি লেখা হয়েছে, সেই ভাষাটি আয়ত্তে থাকলে, বইটিকে আপন করে নেয়া যায়। বইয়ের রচয়িতাকে উপলব্ধি করা যায়। ইংরেজী ভাষা, যে কারণেই হোক, আজকে বহুল ব্যবহৃত ভাষা। অনেক বই ইংরেজী ভাষায় সরাসরি লিখে থাকেন বিভিন্ন দেশের লেখকরা যাদের মাতৃভাষা ইংরেজী নয়, কিন্তু ভাষাটি তারা নিজের ভেতর আত্মস্থ করেছেন, মনেই হয় না যে এটা তার নিজের ভাষা নয়। উদাহরণ টেনে এনে বলা যেতে পারে অভিবাসী ভারতীয়, বাংলাদেশী, পাকিস্তানী, শ্রীলঙ্কান, জাপানী ও চীনা লেখকরা পশ্চিমের বাজার দখল করেছেন। পাশ্চাত্যের পাঠকদের কাছে এসব দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লেখকদের বিপুল পাঠকপ্রিয়তা রয়েছে। আসলে ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগেও অন লাইনে বই পড়ে থাকেন কিছু পাঠক, তারপরও জীবন্ত বইয়ের পাঠকের সংখ্যা একেবারে কমে যায়নি।
এমনিতে সারা বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বিচিত্র সব চ্যানেলের দৌরাত্ম্যে মানুষের পাঠাভ্যাস ক্রমে কমে যাচ্ছে। মানুষ পারতপক্ষে বই পাঠ করতে চায় না। তারপরও কিছুসংখ্যক বিদগ্ধ পাঠক আছেন যারা ভালো বই কেনন, ভালো বই সংগ্রহে রাখতে ভালোবাসেন, ভালো বই পাঠ করে ঋদ্ধ ও আনন্দিত হন।
গত বছর (২০১২) উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে সারা বিশ্বে। পৃথিবীর খ্যাতিমান বইবিপণি যেমন ভিনটেজ, পেংগুইন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বই ছেপেছে। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের নাম বছরের শেষপ্রান্তে এসে সুইডেন থেকে ঘোষণা দেয়ার পর, হইহই রইরই করে প্রকাশকরা বই ছাপতে আগ্রহী হয়। বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বইয়ের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। রইল বাকি পুলিৎজার। তাছাড়া কমনওয়েলথ পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদেরও খাটো করে দেখার উপায় নেই। সবকিছু মিলিয়ে গত বছর (২০১২) ছিল বইয়ের বাজার রমরমা।
ইতোমধ্যে বেশ ক’টি দেশে আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এগুলোর অন্যতম ফ্রাংকফুর্ট বইমেলা সারা বিশ্বের বিপুলসংখ্যক বইপ্রেমিক পাঠক ও প্রকাশকদের সমারোহ ঘটিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক বইয়ের বাজার।
বছরের শেষে যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন চীনের লেখক মো ইয়ান। তার বই পরিচিতি বাংলাদেশে ছিল না বললেই চলে। এখন বছর শেষ না হতেই তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলো ঢাকার সম্ভ্রান্ত বই বিপণিগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ‘রেড সরগাম’ (জঊউ ঝঙজএটগ), চেঞ্জ ঈঐঅঘএঊ, পাও (চঙড) এবং আরও কিছু বই এখন বিদগ্ধ পাঠকের নাগালে।
মো ইয়ানের ডজনখানেক ছোট গল্প ইতোমধ্যে বাংলায় অনূদিত হয়ে বাংলাদেশের পাঠকদের আপ্লুত করেছে এবং প্রায় অচেনা এই লেখকের প্রতি হঠাৎ এক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
মো ইয়ানের ‘রেড সরগাম’ একটি অনবদ্য উপন্যাস। রসুনের চাষ ও ক্ষেতমজুরদের সমস্যা নিয়ে লেখা এই প্রতীকী উপন্যাস চীনের সমসাময়িক রাজনীতি ও সামাজিক সমস্যাকে চিত্রিত করেছে। লেখক চীনের আত্মাকে স্পর্শ করতে পেরেছে বলে কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন।
সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ী জাপানের পাঠকপ্রিয় লেখক মুরাকামির বইও ঢাকায় এসেছে। গতবারের নোবেল বিজয়ী (২০১১) লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিক মারিয়া ভার্গস য়োসার বইগুলো ২০১২ সালে আবার এসেছে এবং বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে তৈরি হয়েছে নতুন আগ্রহ। লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিক কবি, প্রবন্ধকার ও নাট্যকারদের লেখা বাংলাদেশে আশির দশকে পরিচিতি পেতে শুরু করে। গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ, মারিয়া ভার্গোস য়োসা, বোর্হেস, পাবলো নেরুদার ইংরেজীতে অনূদিত হয়ে পরবর্তী পর্যায়ে বাংলায় রূপান্তরিত হতে থাকে। আমাদের স্প্যানিশ জানা কয়েক অনুবাদক সরাসরি মূলভাষা থেকে এদেরকে অনুবাদ করে বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেন।
গত বছরের (২০১২) বইয়ের জগতের সামগ্রিক চিত্রটি বেশ আশাব্যঞ্জক। দু’বার বুকার বিজয়ী ম্যানটেলের নতুন বইটি ইতিহাসভিত্তিক হলেও পাঠকরা তার প্রতি আগ্রহী হয়েছেন।
বাংলাদেশের ইংরেজীতে লেখা উপন্যাসও পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করেছে। কাজি আনিস আহমেদের ‘গুডবাই, কিসিঞ্জার’ ছোটগল্প গ্রন্থটি আমাদের এতদাঞ্চলের শুধু নয়, বাইরের দেশগুলোতেও আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয়। তিনি এর আগে ইংরেজীতে একটি চটি উপন্যাস ‘ফোর্টি স্টেপস’ লিখে দেশে বিদেশে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, যা কলকাতার খ্যাতিমান অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘চল্লিশ কদম’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।
তরুণ লেখিকা, একটি ইংরেজী দৈনিকের সম্পাদক তনয়া তাহমিমা আনাম তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য গুড মোসলেম’ বইটি বাংলাদেশের পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। তার প্রথম উপন্যাসে যে সীমাবদ্ধতা ছিল, তা এই উপন্যাসে কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। সামনে পড়ে আছে বিশাল ভবিষ্যত, তাহমিমা নিশ্চয়ই আমাদের আরও বৈচিত্র্যময় উপন্যাস উপহার দেবেন। আমরা তার সম্পর্কে আশাবাদী।
সালমান রুশদী, খ্যাতিমান বিতর্কিত অভিবাসী লেখক ছদ্মনামে একটি আত্মজীবনী জোসেফ আন্তন : আ’মেমোয়ার লিখে তুমুল আগ্রহ সৃষ্টি করেছেন সারা বিশ্বে শুধু নয়, বাংলাদেশেও। এই বিশাল গ্রন্থটি একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে তার সাহিত্য ক্যারিয়ারে।
ইতিহাসবিদ এবং অভিবাসী লেখক তপন রায় চৌধুরী ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন আওয়ার টাইম’ নামে যে বইটি লিখেছেন, তা ঢাকার বনেদী বই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তাঁর ইংরেজী গদ্য যদিও অন্য এক অভিবাসী লেখক নোবেল বিজয়ী ভিএস নাইপলের মতো সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তবুও তথ্যকীর্ণ এই গ্রন্থটি তার সময় ও পারিপার্শ্বিকতাকে তুলে ধরেছে। বছর শেষে আসা এই বইটি বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন। এ বইটি বাংলায় অনুবাদ হলে নিঃসন্দেহে পাঠকপ্রিয়তা পাবে। এর আগে তপন রায় চৌধুরী ‘বাঙালনামা’ লিখে বাঙালী পাঠকদের প্রিয় হয়েছিলেন। ইংরেজীতে লেখা, এই প্রামাণ্য দলিলটি সাহিত্যের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রতিবছর অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্তির সাথে সাথে বইয়ের প্রকাশ ও প্রচার বাড়ে কমে।
অতএব যত বিতর্কিত হোক না কেন নোবেল পুরস্কার, বইয়ের বাজারে এর একটা প্রবল প্রভাব রয়েছে।
পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার ব্যাপারে এসব লেখক ও তাদের রচিত অবিস্মরণীয় গ্রন্থগুলো আমাদের কাছে এক বিশাল তাৎপর্য বহন করে। সামনের বছরও ভালো ভালো বই গ্রন্থজগতকে প্রভাবিত করবে, এই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.