হলমার্ক by শাহ আলম খান

জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অখ্যাত প্রতিষ্ঠান হলমার্ক গ্রুপের বিপুল পরিমাণ অর্থ তসরুফের ঘটনাই ছিল বিদায়ী বছরে আর্থিক খাতে সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়।
হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদকে সামনে রেখে সুবিধাভোগী বিভিন্ন গোষ্ঠী কর্তৃক অবৈধভাবে ও বিচিত্র উপায়ে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা শুধু ব্যাংকিং খাতকেই নয়, দেশজুড়ে, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ঘটনার আকস্মিকতা ও প্রতিক্রিয়া এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যেখানে ব্যাংকিং খাতের অসংখ্য সাফল্যও ধামাচাপা পড়ে যায়। এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, ব্যাংকার থেকে সাধারণরাও বলছেন, অর্থ লোপাটের পরিমাণ এবং লোপাটে বিচিত্র পদ্ধতি অবলম্বন যে কোন বিচারেই এটি দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও কলঙ্কজনক ঘটনা।
হলমার্ক জালিয়াতির ঘটনার সূত্রপাত সেই ২০১০ সাল থেকে। এর ব্যাপ্তি ছিল বিদায়ী (২০১২) বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত। আর জালিয়াতির কেন্দ্রস্থল ছিল সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা। এখান থেকেই বিভিন্ন সময়ে অভিনব পন্থা অবলম্বন করে অবৈধভাবে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় হলমার্ক গ্রুপ। এই জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে নকশি নিট কম্পোজিট, খান জাহান আলী সোয়েটার্স এবং ডিএন স্পোর্টসসহ ৫ প্রতারক প্রতিষ্ঠানের। তবে এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই অর্থ লোপাট করেছে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই চারদিকে তোলপাড় শুরু হয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়ায়, যা গোটা আর্থিক খাতকেই চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। যার রেশ সমগ্র ব্যাংকিং খাতকে এখনও বহন করতে হচ্ছে।
এদিকে সোনালী ব্যাংক থেকে এ পুকুর চুরির ঘটনাটি প্রথম ধরা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানেই। এতে হদিস মেলে হলমার্ক বিভিন্ন সময়ে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তার ৭০-৮০ ভাগই ছিল নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানীয় ঋণপত্র (এলসি) খুলে অর্থ বের করে নেয়ার ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে আরও ধরা পড়ে হলমার্কের সঙ্গে অর্থ লোপাটের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জড়িত। এতে রাজনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনৈতিক সুবিধা নেয়ার অভিলাষও নগ্নভাবে প্রকাশ পায়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অবহিত করে চিঠি দেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগ প্রতিষ্ঠান, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতেও একই চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠিতে কেবল ব্যাংকের কর্মকর্তাই নন, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখতে বলা হয়। চিঠিতে দায়ী ও সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে এমন সব কর্মকর্তার নামও দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে কারসাজির মাধ্যমে উত্তোলন করা টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে কিনা, তা-ও অনুসন্ধান করে দেখতে বলা হয়েছে। উত্তোলন করা টাকা অন্য কোন ব্যাংকে রাখা হয়েছে কিনা, সেটিও খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ ব্যাংক দুদককে সহায়তা করবে বলে জানানো হয়।
ওদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধে দুদকও এই ঘটনায় হলমার্ক গ্রুপের পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত শুরু করে। চলতি বছরের জুন মাসের ১০ তারিখ থেকে ছয় সদস্যের টিম এ নিয়ে অনুসন্ধান কাজ শুরু করে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দীর্ঘ তদন্তে তদন্ত কমিটি হলমার্ক গ্রুপের এমডি, চেয়ারম্যান, কর্মকর্তা, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখাসহ প্রধান কার্যালয়েরও ততোধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এতে বাদ যাননি সরকারের এক উপদেষ্টাও। অনুসন্ধানকালে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের ১১ সদস্য, হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ, চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, জিএম তুষারসহ মোট ৭৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক কর্মকর্তারা।
এরপর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে দুদকের তদন্ত কমিটি। ওই প্রতিবেদন আরও যাচাই-বাছাই করে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২৭ জনের বিরুদ্ধে গত ২ অক্টোবর রাজধানীর রমনা মডেল থানায় ১১টি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দায়েরকৃত মামলায় হলমার্ক গ্রুপের ৭ জন এবং সোনালী ব্যাংকের ২০ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।
তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ঘটনা প্রকাশ হওয়ার প্রায় ৭ মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে লোপাট হওয়া টাকা উদ্ধার করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি অথবা আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনী।

No comments

Powered by Blogger.