বিএনপির সফলতা ‘জনসমর্থন আদায়’ by রিয়াদুল করিম

নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি গত বছর হরতাল-অবরোধসহ বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করলেও দৃশ্যত কোনো সফলতা আসেনি। তবে বিএনপির নেতারা মনে করছেন, গত বছর তাঁদের প্রধান অর্জন জনসমর্থন আদায়।
বিএনপির নেতারা বলছেন, জনসমর্থনকে পুঁজি করে এ বছরের শুরু থেকে তাঁরা আস্তে আস্তে কঠোর আন্দোলনের দিকে যাবেন। ফেব্রুয়ারি-মার্চেই শুরু হবে ‘চূড়ান্ত আন্দোলন’। পাশাপাশি আন্দোলনের ‘কৌশল’ হিসেবে নতুন বছরের প্রথম সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ারও চিন্তা আছে দলের ভেতরে। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বছরজুড়ে বিএনপির আন্দোলন ছিল মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে এবং দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর ‘গুম’ হওয়ার প্রতিবাদে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তিনটি হরতাল, খালেদা জিয়ার কয়েকটি জনসভা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে রোডমার্চ, এক দিনের রাজপথ অবরোধ ও খালেদা জিয়ার গণসংযোগ কর্মসূচি ছিল উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে ইলিয়াস আলীকে ‘জীবিত ফেরত দেওয়ার’ দাবিতে ছয় দিন হরতাল করে বিএনপি। তবে এই প্রধান দুই দাবির কোনোটিই পূরণ হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সরকারকে একবার ‘আলটিমেটাম’ও দিয়েছিলেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। কিন্তু তাঁরা সরকারকে টলাতে পারেননি। উল্টো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে নিজেদেরই নীতিগত অবস্থান কিছুটা বদলেছে বিএনপি। প্রথম দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি করে এলেও বিএনপি এখন বলছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিএনপির চলমান আন্দোলনের বড় সফলতা হচ্ছে জনসমর্থন আদায়। বিএনপির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন; এই দাবিতে তাঁরা জনমত গড়তে পেরেছেন বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর দাবি, সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করছে। প্রথম দিকে বিএনপির কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের সাড়া কম থাকলেও বছর শেষে দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর সঙ্গে সাধারণ মানুষও কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে।
বিএনপির অন্যতম এই নীতিনির্ধারক বলেন, এ বছরের শুরু থেকে আস্তে আস্তে কঠোর আন্দোলনের দিকে যাবে বিএনপি। জানুয়ারি মাসে পরীক্ষা ও ইজতেমার কারণে কর্মসূচি কম থাকবে। তবে ফেব্রুয়ারি-মার্চে শুরু হবে চূড়ান্ত আন্দোলন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো আন্দোলনই বিফল হয়নি। তবে বিএনপির একটি দুর্বলতা আছে; সেটি হলো, বিএনপি কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষেত্রে জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে। আমাদের অনেক নেতা-কর্মীও বলেন, কেন আমরা কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছি না। আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে সরকারকে সময় দিতে চাই।’
দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন মনে করেন, তাঁদের আন্দোলন শতভাগ সফল। তিনি বলেন, এখন নিভৃত গ্রামের চায়ের দোকানেও সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কথা হচ্ছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণেই মানুষ এসব বিষয়ে সচেতন হয়েছে। মানুষ যে জেনেছে, এটাই বিএনপির সফলতা। তিনি বলেন, বিএনপি সচেতনভাবেই হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি এড়িয়ে নতুন নতুন ধারার কর্মসূচি দিয়েছে। আর এভাবেই সরকারকে চাপে ফেলতে তাঁরা সক্ষম হবেন বলেও তিনি মনে করেন।
গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে সই করেন রায় প্রদানকারী বিচারপতিরা। এর আগে সংক্ষিপ্ত রায়ে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেন আপিল বিভাগ। তবে এর আওতায় আগামী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেওয়া হয়।
আদালতের ওই রায়ের ভিত্তিতে মহাজোট সরকার সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এর পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। গত বছর এই দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট তিনটি হরতাল করে। ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক রোডমার্চ কর্মসূচি শেষে গত ১২ মার্চ ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। সেই সমাবেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে তিন মাসের আলটিমেটাম দেন খালেদা জিয়া। গত ১০ জুন বিএনপির বেঁধে দেওয়া সময়সীমা শেষ হয়। পরদিন ১১ জুন এক সমাবেশে খালেদা জিয়া পাঁচটি বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
১৭ এপ্রিল রাতে নিখোঁজ হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। ইলিয়াস আলীকে জীবিত ফেরত পাওয়ার দাবিতে দুই দফায় ছয় দিন হরতাল করে বিএনপি। হরতাল চলাকালে গাড়ি পোড়ানো ও সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের ৩৩ নেতাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২৯ এপ্রিল বিএনপির নেতাদের নামে মামলা দায়ের এবং পরে তাঁদের জেলে পাঠানোর পর থেকে মূলত দলীয় কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দেয়। রাজপথে আন্দোলন থেকে পিছু হটে দলটি। প্রায় দেড় মাস কারাগারে থাকেন ফখরুলসহ অন্য নেতারা।
আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ডিসেম্বরে রাজপথ অবরোধ, হরতাল ও গণসংযোগ কর্মসূচি চালায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। এর মধ্যে গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১০ ডিসেম্বর আবার গ্রেপ্তার হন।

No comments

Powered by Blogger.