কল্পকথার গল্প-আমরা যেন বছরজুড়ে সুখে-শান্তিতে থাকি by আলী হাবিব

বছর একটা গেল বটে! কথায় আছে, আনলাকি থার্টিন। সেই তেরোর গেরো লাগার আগেই বারোতে বারোটা বাজার দশা। কী সব কাণ্ডই না ঘটে গেল বছরজুড়ে! শুধু কাণ্ড বললে কি সবটুকু বলা হবে? বলতে হবে প্রকাণ্ড।
তা প্রকাণ্ড ব্যাপার-স্যাপারই বটে! বছরের শেষে কারো পৌষ মাস যাচ্ছে, কারো ক্রিসমাস গেছে। দেশের সর্বনাশ কতটা ঠেকানো গেছে, সেটা বুঝতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। প্রচলিত কিছু কথা আছে, যা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। এ রকমই একটা কথা, কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। কথাটা বিশ্লেষণ করতে গেলে ধরা যেতে পারে, পৌষ মাস খুব সুখের একটা মাস। কিন্তু এই মাসে এবার যে শীত পড়ছে, তাতে অনেকের কাছেই ব্যাপারটা আর আনন্দের থাকছে না। মাঝেমধ্যেই সূয্যিদেব মুখ দেখাতে কার্পণ্য করছেন। ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চরাচর। এবার পৌষ পূর্ণিমার চাঁদও কুয়াশার চাদরে ঢাকা না পড়ে! রাজধানী ঢাকায় আবার ধোঁয়ার সঙ্গে কুয়াশা মিলে ধোঁয়াশা নামের কী একটা জিনিস নাকি তৈরি হয়! আবহাওয়া এমন থাকবে না। কুয়াশা দেখে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। 'আড়ালে তার সূর্য হাসে'- সেই সূর্য একদিন কুয়াশার চাদর সরিয়ে ঠিকই মুখ বের করবে। উত্তাপ দেবে আমাদের।
কিন্তু বাংলার রাজনীতির আকাশে যে কুয়াশা একটু একটু করে আলো ঢেকে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তা কি সহজে কাটবে? নতুন বছর এলে প্রতিবারই রাশি নিয়ে রাশি রাশি লেখালেখি হয়। বছরটি কেমন যাবে- কার সঙ্গে কার প্রেম হবে, কোন বেকারের চাকরি হবে, কোন প্রেমিকের পথের কাঁটা সরে যাবে, এমন নানা বিষয়ের পূর্বাভাস থাকে রাশিফলে। আজকাল পাথরে ভাগ্য ফেরানোর বিজ্ঞাপনও দেখি কাগজে ছাপা হয়। কিন্তু জাতির ভাগ্য যে পাথর-চাপা পড়ে আছে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার দায়িত্ব কার? প্রশ্ন হচ্ছে, বারোতে বারোটা বাজালো কে?
বছরের শুরু থেকেই আমাদের কথা ও কাজের কোনো মিল নেই। আমরা কোন কথা যে বলি আর কোন পথে যে চলি- তার কোনো নিশানা নেই। বলি এক, তো করি আরেক। যা করি, তা বলি না। যা বলি, তা করি না। কোনো কোনো সময় আমাদের ভেতরে জাতীয়তাবোধ এতটাই প্রবল হয়ে দেখা দেয় যে আমাদের স্থান-কাল-পাত্রজ্ঞানও লোপ পায়। আমরা 'ধরি ধরি সন্ধান করি'; কিন্তু খুঁজে পাই না। আমাদের শর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ভূত, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার জন্য হেঁদিয়ে বেড়াই। আমাদের স্বভাব বড় অদ্ভুত। কেউ সামনের দিকে এগোতে চাইলে আমরা তাকে পেছন থেকে টানতে থাকি। আবার কখনো এমন ধাক্কা দিই, যাতে কেউ তার পতন ঠেকাতে না পারে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে কে আর আমাদের চেয়ে দড়! অন্যের পায়ে কুড়াল মারার ব্যাপারেও আমাদের জুড়ি নেই। 'আমরা যা খুশি তাই করি', পরাই পরের গলায় দড়ি। সুযোগ পেলে অর্থাৎ সময়মতো ছড়ি ঘোরাতে আমাদের দেরি হয় না। তার পরও আফসোস, কোনো কবি এখনো লিখলেন না- 'এমন জাতি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি'।
তা ঠিক। এমন জাতি কোথাও খুঁজে আর পাওয়া যাবে না। মানুষ না চাইলেও তাদের মনের ভেতর আশার বীজ বপন করে দিতে আমাদের জুড়ি নেই। পারি বা না পারি, স্বপ্ন দেখাতে আমাদের চেয়ে ভালো আর কেউ পারে না। আমরা কথায় কথায় কথা দিয়ে ফেলি। আবার সময় গেলে যখন দেখা যায় সাধন হলো না, তখন নিজের পাতে ঝোল টানতে দ্বিধা করি না। যখন অন্যের ঘরে আগুন লাগে, তখন আমরা সেখানে আলু পুড়িয়ে খাওয়ার সুযোগ খুঁজি। ওই আগুনে নিজেদের ঘরও যে পুড়তে পারে, সেদিকে আমাদের একটুও খেয়াল থাকে না। আমরা কথায় কথায় পাহাড় ডিঙিয়ে চলে যাই। কল্পনার সাগরে নৌকা ভাসিয়ে দিতে আমাদের একটুও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয় না।
সে যাকগে! বারোতে কী করে বারোটা বাজল কিংবা যে সংখ্যার মারপ্যাঁচে যে বারো বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেই বারো কী করে আমাদের বারোটা বাজাল, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার আগে একটু বারো সংখ্যাটার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বারোটা বেজে যাওয়া মানে যতই অমঙ্গলের কথা হোক না কেন- বারো কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো কোনো সংখ্যা নয়। দিন কিংবা রাতের বিভাজন তো বারো দিয়ে। ক্যালেন্ডারের তারিখ পরের দিনে চলে যায় ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বাজলে। যেমন কাল রাতে ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরোতেই মহাসমাদরে বরণ করে নেওয়া হয়েছে নতুন একটি বছরকে। দিনের বেলা বারোটা বাজলে এএম গড়িয়ে পিএম হয়ে যায়। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। রাত বারোটার পর পিএম থেকে এএম।
কাজেই বারোকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। পুরাণ থেকে শুরু করে উপকথা- সর্বত্রই বারো নিয়ে কারবার- এমনকি আজকের তথ্যপ্রযুক্তিকে আমাদের হাতের কাছাকাছি এনে দিয়েছে যে যন্ত্র, সেই কম্পিউটারেও বারোর কারবার। কম্পিউটারের ফাংশনিং কি-র সংখ্যা বারো- এফ১ থেকে শুরু করে এফ১২। আবার বারো নিয়ে সিনেমা হয়েছে, টেলিভিশনের নাটক হয়েছে। কিন্তু এই বারো আমাদের বারোটা বাজাল কী করে?
না, মোটেও ভালো যায়নি আমাদের বারো, মানে ২০১২। জ্যোতিষীদের হিসাবে যে বছরটির ভর ছিল পাঁচ। গেল বছর আমাদের কী সব দিন গেছে। বছরের শুরুটা যে খারাপ ছিল, তা বলা যাবে না। কিন্তু আগের তিন বছরের অর্জন প্রায় বর্জন করে ফেলেছি আমরা ২০১২ সালে এসে। দেশে কি শান্তি ছিল আগের বছর? তা সে যাঁরা বছরটা কাটিয়েছেন, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে কিংবা ঘাতকের দৃষ্টি এড়িয়ে বেঁচে-বর্তে আছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন, কেমন গেল ২০১২। বিদেশিরা আমাদের চোর বলে গেল। বিদেশিদের চোখে আমরা দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রকারী হয়ে গেলাম এই ২০১২ সালে। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকা জালিয়াতি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা দেখার কেউ নেই। আমরা মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো করে এ চেয়ার থেকে লোক সরিয়ে ও চেয়ারে বসিয়েও শেষ রক্ষা কতটা করতে পেরেছি। আমাদের সাগর-রুনি নেই। তরুণ এ সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র ছেলেটি এখনো খুঁজে বেড়ায় তার মা ও বাবাকে। আমাদের ললাটে হলমার্ক নামের কেলেঙ্কারি যুক্ত হয়েছে ২০১২ সালেই। বাংলাদেশের সংবিধান থেকে এক সময় ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটুও বিনষ্ট করা যায়নি। বাংলাদেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ কখনো ছিল না। কিন্তু সেখানেও কালিমা লেপন করে দিল এক শ্রেণীর অসাধু মানুষ। রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার মতো লজ্জাজনক ঘটনা তো বাংলাদেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি কখনো। এখানে সেতু হয় না। সেতুর জন্য চাঁদাবাজি করতে গিয়ে অতি-উৎসাহীদের প্রাণ যায়। এখানে একটি স্বপ্নের সেতু ঘিরে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়।
রাস্তঘাটে এখানে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিত নয় গৃহকোণেও। জীবন হাতের মুঠোয় করে প্রতিদিনের চলা। হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মানুষের নৈতিক সমর্থন না থাকলেও ২০১২ সালে জীবন থমকে ছিল এসব কর্মসূচিতে। ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনাও।
আজ থেকে নতুন যে বছরটি শুরু হচ্ছে, জ্যোতিষীদের হিসাবে নতুন এ বছরের ভর হচ্ছে ছয়। এ বছরে আমরা যেন করতে পারি জয়। আর কোনো অনিশ্চয়তা নয়। নতুন বছরে নতুন করে হোক শুরু আমাদের যাত্রা। একটাই প্রার্থনা শুধু, সবাই যেন বজায় রাখেন সেই বোধ- যে বোধের নাম মাত্রা। এই নতুন বছর নিয়ে এক পদ্যাকারের লেখা থেকে কয়েক ছত্র তুলে দেওয়া যাক। তিনি লিখেছেন, 'নির্বাচনের আর তো মোটে একটা বছর বাকি/ভালোয় ভালোয় কাটুক বছর থার্টিন হোক লাকি/আমরা যেন বছরজুড়ে শান্তি-সুখে থাকি। তিন বেলাতেই জুটুক সবার মোটা চালের ভাত/দূর হয়ে যাক এ দেশ থেকে সন্ত্রাস ও সংঘাত।'
নতুন বছরে এই হোক আমাদের প্রার্থনা। রাজনীতি যেন এ প্রার্থনা মঞ্জুর করে।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.