আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ by মুস্তাফা মাসুদ

ঘটনাবহুল ২০১২ সাল বিদায় নিল, এলো নতুন বছর ২০১৩। বিগত একটি বছর জুড়ে বিশ্বব্যাপী ঘটেছে কত বিচিত্র ঘটনা। কিছু তার আনন্দের, খুশির। কিছু ঘটনা বেদনার; যুদ্ধ-বিগ্রহ আর রক্তপাতের; রাজনৈতিক কূটচাল আর পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকির ঘটনাও আছে। সব মিলিয়ে ২০১২ সাল ছিলো নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। মানুষের মানবিক বিবেক আহত হয়েছে কোন কোন ঘটনায়। বিগত বছরে বিশ্বব্যাপী ঘটে-যাওয়া ২৬টি ঘটনা সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বশীর্ষ পরাশক্তি। এই ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৬ নবেম্বর, ২০১২। এই নির্বাচনে ডেমোক্রাট দলীয় বারাক ওবামা দ্বিতীয় বারের মতো প্রার্থী হন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রিপাবলিকান দলীয় মিট রোমনি। নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে ওবামা পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এই নির্বাচনে ওবামা পপুলার ভোট পান ৬ কোটি ৫৬ লক্ষ ৪২৫; আর ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে পান ৩৩২। অন্যদিকে রোমনি পপুলার ভোট পান ৬ কোটি ৮ লক্ষ ৬১ হাজার ৬৮৩; আর ইলেকটোরাল ভোট পান ২০৬টি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ওবামার ভারসাম্যপূর্ণ ও সহনশীল নীতি, জাতীয় সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে তার দৃঢ় প্রত্যয়পূর্ণ মনোভাব ভোটারদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে, যা ছিলো তার বিজয়ের অন্যতম মূলমন্ত্র।
মালালার ওপর তালেবানী হামলা : মালালা ইউসফজাঈ পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সোয়াত উপত্যকার এক অদম্য সাহসী কিশোরী। মাত্র ১৫ বছর বয়সী এই মেয়েটি সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। মালালা নারীশিক্ষার উদ্যমী কর্মী, শিশু ও নারী অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার। কিন্তু সোয়াতের পাকিস্তানী তালেবান জঙ্গিরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ঘোর বিরোধী। তারা নির্দেশ জারি করল- ১৫ জানুয়ারি, ২০০৯-এর পরে কোনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারবে না। কিন্তু সাহসী মালালা তালেবানি নিষেধাজ্ঞা আর হুমকি অগ্রাহ্য করে মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারের কাজ অব্যাহত রাখে। গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়ে আর ব্লগ লিখে সে নারীশিক্ষার পক্ষে প্রবল জনমত গঠনে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে ধর্মান্ধ তালেবানরা ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর মালালার ওপর গুলি চালায়। গুরুতর আহত মালালা লন্ডনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন; ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠছে। তার প্রতি কাপুরুষ তালেবানদের জঙ্গী হামলার ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে ধিক্কার ও নিন্দার ঝড় উঠেছে। জাতিসংঘ ১১ নবেম্বরকে ‘মালালা দিবস’ ঘোষণা করে এ অকুতোভয় কিশোরীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি লাভ: ৩০ নবেম্বর, ২০১২ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে। স্বীকৃতির প্রশ্নে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১৩৮টি; বিপক্ষে মাত্র ৯টি। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র এই স্বীকৃতির বিরোধিতা করে কড়া বিবৃতি দেয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিন এবং জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্য দেশ এই স্বীকৃতিকে স্বাগত জানায়। ফিলিস্তিন বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্য না হলেও এই স্বীকৃতির ফলে সে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদপ্রাপ্তির দিকে আরো একধাপ এগিয়ে গেল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় যোগ দিতে ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করার সুযোগ লাভ করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট: ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন দেশটির সাবেক একনায়ক পার্ক চুং হি’র মেয়ে ৬০ বছর বয়সী পার্ক জিউন হাই। দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ৫৯ বছর বয়সী মুন জায়ে ইন। নির্বাচন বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। এতে পার্ক জিউন হাই শতকরা ৫১.৬ ভাগ এবং মুন জায়ে ইন ৪৮ ভাগ ভোট পান। জানা যায়, মিজ পার্ক প্রেসিডেন্ট পদে লড়বার জন্য দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং সেভাবে নিজেকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টায় নিবেদিত থেকেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার নানামাত্রিক রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে তিনি নিজেকে একজন মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
বেনগাজি হত্যাকা-: মধ্যপ্রাচ্যে আরব-বসন্তের ধাক্কায় লিবীয় একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হয় এবং দেশটির নতুন শাসকগোষ্ঠী দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করে। গাদ্দাফির পতনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখে; এতে গাদ্দাফিপন্থী এবং মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলো। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এক চলচ্চিত্র নির্মাতা নকুলা বাসিলে নকুলা ইসলাম অবমাননাকারী একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তার অংশবিশেষ ইউটিউবের মাধ্যমে রিলিজ করে। এতে মুসলিমবিশ্বে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়; সারাবিশ্বে সহিংস প্রতিবাদ শুরু হয়। ধারণা করা হয়, এরই ধারাবাহিকতায় পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে গত ১১ সেপ্টেম্বর একদল জঙ্গী লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন কনস্যুলেটে সশস্ত্র হামলা চালায় এবং লিবিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন ক্রিস্টোফার ইভেন্সকে হত্যা করে। রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের কর্মকর্তারা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।
যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল-ছাত্রদের ওপর গুলি: মার্কিন যুক্রাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের নিউটাউন শহরের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে ২০ ডিসেম্বর, ২০১২ এক মর্মান্তিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। ওই দিন অ্যাডাম নামের ২০ বছর বয়সী এক তরুণ বন্দুকধারী স্কুলের শিক্ষার্থী শিশুদের ওপর আকস্মিকভাবে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী ২০টি শিশু, স্কুলের ৬ জন শিক্ষক, অন্য এক ব্যক্তি এবং বন্দুকধারী ঘাতকসহ মোট ২৭ জন নিহত হয়। নিহত শিক্ষকদের মধ্যে হত্যাকারী তরুণের মা-ও ছিলেন। এই মর্মান্তিক ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দুঃখভারাক্রান্ত ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আজ আমাদের হৃদয় ভেঙ্গে গেছে। এ শিশুদের মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবার জন্য আমাদের মন আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত। এর সান্ত¦না জনাবার ভাষা আমার জানা নেই।’ বিশ্বের বড় বড় নেতা এই ঘটনায় আন্তরিক দুঃখ ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
উল্লেখ্য, হত্যাকাণ্ডের কোন কারণ জানা যায়নি।
সিরিয়ায় গণহত্যা: সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ ২০১২ সালে আরও ব্যাপকতা লাভ করে। প্রেসিডেন্ট বাশারের সরকারী বাহিনী আর বাশার-বিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে লড়াই অব্যাহত থাকে সারা বছর। এ সময় সিরিয়া পরিণত হয় কার্যত এক মৃত্যু-উপত্যকায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সিরিয়ার ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে বিগত বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৪৫ হাজার ৫০১ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বেসামরিক লোকের সংখ্যাই বেশি। ওয়েব সাইট থেকে প্রাপ্ত অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নিহতের সংখ্যা ৫৬ হাজারেরও বেশি। ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, রক্তপাত আর আতঙ্কিত-অনিশ্চিত জীবনের সহযাত্রী হয়ে সিরিয়ার মানুষ পার করল আরো একটি দুঃস্বপ্নের বছর ২০১২।
ইউটিউব ভিডিও চিত্র: ইসলাম অমমাননাকারী ভিডিও চিত্র ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নির্মাণের প্রতিবাদে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। আমেরিকার নাগরিক নকুলা বাসিলে নকুলা এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করে তার অংশবিশেষ ১২ জুলাই, ২০১২ ইউটিউবে আপলোড করেন, যা প্রচারিত হয় ৯ সেপ্টেম্বর। ইসলাম অবমাননাকারী এই চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিবাদে ১১ সেপ্টেম্বর মিসরে, তার ধারাবাহিকতায় মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়, আহতও হয় অনেকে। লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হত্যার ঘটনা ইউটিউব ভিডিওর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা হয়।
মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: আরব-বসন্তের উত্তুঙ্গ ঝড়ে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের দীর্ঘ ত্রিশ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান হলে ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি পদত্যাগ করেন এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক পরিষদ ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই পরিষদ মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ২০১২ সালের মে ও জুন মাসে দু’দফায়। প্রথম দফা নির্বাচন হয় ২৩-২৪ মে; আর দ্বিতীয় দফা অর্থাৎ চূড়ান্ত নির্বাচন হয় ১৬-১৭ জুন। এই নির্বাচনে ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড দলের প্রধান মোহাম্মদ মুরসি ৫১.৭৩% ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মোবারক সমর্থক আহমেদ শফিক। তিনি শতকরা ৪৮.২৭ ভাগ ভোট পান।
হুগো শ্যাভেজ পুনর্নির্বাচিত: তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনিজুয়েলার লৌহমানব হুগো শ্যাভেজ টানা তৃতীয় বারের মতো দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। গত ৭ অক্টোবর, ২০১২ তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ৫৫.০৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অপেক্ষাকৃত তরুণ রাদোনস্কি পান ৪৪.৩১% ভোট। শ্যাভেজ ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত আছেন। জানা যায়, প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ এক শ্রমজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজের বুদ্ধি, প্রতিভা আর অধ্যাবসায়ের কারণে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে সক্ষম হন।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠন: ১৫ নবেম্বর, ২০১২ চীনের শাসক দল চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। কম্যুনিস্ট পার্টির ১৮তম কংগ্রেসে এদিন চীনা নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন এনে পার্টি পুনর্গঠন করা হয়। সাবেক নেতা হু জিন তাও-এর পরিবর্তে পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি পদে নির্বাচিত হয়েছেন জি জিনপিং। পলিট ব্যুরো স্টান্ডিং কমিটির অন্য সদস্যবৃন্দ হলেন: লি কেকিয়াং, ঝাং দেজিয়াং, উ ঝেংসেং, লিউ ইউনসান, ওয়াং কিশান ও ঝাং গাওলি।
মমতা ব্যানার্জির ইউপিএ জোট ত্যাগ: তৃণমূল কংগ্রেস সভানেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক ডিগবাজি ২০১২ সালে ভারতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে আলোচিত একটি প্রসঙ্গ। তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স বা ইউপিএ জোটের শরীক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন। কেন্দ্রে তার দলের সংসদ সদস্য ১৯জন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সংগে নীতিগত মতপার্থক্যের কারণে অনেকটা আকস্মিকভাবেই ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে তার দলের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। তিনি তার দলের সমর্থন প্রত্যাহারের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিলেন; কিন্তু রাজনৈতিক সূক্ষ্ম হিসাবের কারণে সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব ত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে এসে ইউপিএ সরকারকে সমর্থন দিলেন। বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতীও সমর্থন জানালেন ইউপিএ জোটকে। ফলে কংগ্রেস অটুট রইল; কিন্তু মমতা ব্যানার্জি পড়লেন সংকটে। কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অনিশ্চিত রাজনীতির অকূল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন তিনি।
ফ্রান্সের নির্বাচন: ফ্রান্সের রাজনীতিতে এক নাটকীয় পরিবর্তন সূচিত হয় ২০১২ সালের ৬ মে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এই নির্বাচনে বহুল আলোচিত ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজিকে পরাজিত করে ফ্রান্সের ২৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত ফ্রান্সিস ওলাঁদে। এর আগে মি. ওলাঁদে ফ্রেন্স সোশালিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি অব ফ্রান্স-এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
আউং সান সুচি’র ঘুরে দাঁড়ানো: মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি দীর্ঘদিন থেকেই বিশ্ব-মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি পার্লামেন্টে ৮১% আসন লাভ করলেও সেদেশের স্বৈরশাসক গোষ্ঠী তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাকে গৃহবন্দী করে রাখে এবং তার রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। অবশেষে ১৩ নবেম্বর, ২০১০ তার গৃহবন্দিত্বের অবসান হয়। ২০১২ সালের বার্মিজ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস নির্বাচনে সু চি বিজয়ী হন। ২ মে, ২০১২ থেকে মিয়ানমারের বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। সু চি’র এই উত্থান আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার বিপুল বিজয় ও ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
হারিকেন স্যান্ডি: ৩১ অক্টোবর, ২০১২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডি দানবীয় আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে আটলান্টিক উপকূলবর্তী বৃহত্তর অ্যান্টিলেস, বাহামা দ্বীপপুঞ্জ, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় বিশেষ করে মধ্য-আটলান্টিক রাজ্যসমূহ, বারমুডা এবং কানাডার পূর্বাঞ্চলে। হ্যারিকেন স্যান্ডির আঘাতে উপদ্রুত এলাকায় জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৭৫ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত স্যান্ডির আঘাতে ২৫৩ ব্যক্তি মারা যায়; আহত হয় বহু মানুষ। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বিদ্যুত, পানি ব্যবস্থসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। আর্থিক অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ ৬৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ওবামার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফর: ৬ নবেম্বর, ২০১২-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্র দু’সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে বারাক ওবামা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশ সফর করেন। দেশ তিনটি হলো থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমার। ১৮ নবেম্বর থাইল্যান্ড সফরের মধ্য দিয়ে তার এই প্রাচ্য মিশন শুরু হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিন্টন প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী ছিলেন। ওবামার এই সফরকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থ সম্প্রসারণের এবং এ অঞ্চলের রাজনীতি ক্ষেত্রে নবতর মেরুকরণের প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
পৃথিবী ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী ও মায়া ক্যালেন্ডার: মায়া সভ্যতা অত্যন্ত প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সুবিস্তৃত অঞ্চল মেক্সিকো, বেলিজ, গুয়াতেমালা, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া এবং কোস্টা রিকায় এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। আংশিকভাবে হলেও তা টিকে ছিলো খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে স্পেনীয়দের উপনিবেশ স্থাপনের পূর্ব পর্যন্ত। শিল্পকলা, স্থাপত্য, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মায়াদের দক্ষতা ছিলো প্রশংসনীয়। নিজস্ব লিখন-পদ্ধতি ছাড়াও তাদের ছিলো অত্যন্ত সুদৃশ্য ও অসংখ্য সাংকেতিক প্রতীক-সম্বলিত জটিল-প্রকৃতির ক্যালেন্ডার। সামাজিক-আর্থিক ও রাষ্টীয় ক্ষেত্রেও তারা বিস্ময়কর উৎকর্ষ অর্জন করেছিল। এসব উৎকর্ষের পাশাপাশি মায়ারা আবার নানা রকম কুসংস্কার, ভবিষ্যতবাণী ইত্যাদিতে বিশ্বাস করত যার প্রতিফলন ঘটেছে মায়া ক্যালেন্ডারে। এই ক্যালেন্ডার ২০১২ সালকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছে। এ ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রলয় দিবস; অর্থাৎ এদিনেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মানব জাতির সৌভাগ্য যে, মায়া ক্যালেন্ডারের ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়নি পৃথিবী দিব্যি টিকে আছে সর্বংসহা এক অটলতায় স্থিত হয়ে।
মেডিক্যাল ছাত্রীর ওপর পাশবিকতা: ২০১২ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরকে কলঙ্কিত করেছে ভারতের দিল্লীর একটি মর্মান্তিক ঘটনা। গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে চলন্ত বাসের মধ্যে তেইশ বছর বয়সী এক মেডিক্যাল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে ছয় নরপশু। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। দিল্লীর হাসপাতালে এবং পরে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কোন ফল হয়নি। দীর্ঘ তেরোদিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তিনি ২৯ ডিসেম্বর মারা যান মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। তার ওপর এই নিষ্ঠুর ও পাশবিক নির্যাতনের ঘটনায় সারা ভারত জুড়ে প্রতিবাদ ও ধিক্কারের ঝড় ওঠে; দাবি ওঠে ছয় ধর্ষকের ফাঁসির। পাষ-রা ইতোমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছে এবং এ বছরের ৩ জানুয়ারি তাদের বিচার শুরু হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.