নদী বাঁচলে বাঁচবে ধরিত্রী রক্ষা পাবে মানুষ সাংস্কৃতিক আন্দোলন- সংস্কৃতির রূপাতীত ধারায় যুক্ত হলো প্রকৃতি ও মানুষ রক্ষার আবেদন

সমুদ্র হক  নদীকে নিয়ে ভাবনায় পেয়েছে বিশ্বের সকল দেশই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ভাবনা আরও বেশি। বিশেষ করে বাংলাদেশের নদী দিন দিন শীর্ণকায় হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছোটবড় নদীর ওপর দিয়ে পাখি উড়ে যেত সকল মৌসুমে। নদী তীরে ও বালুচরেই কলকাকলিতে ঘর বাঁধত ওরা।
এখন এই দৃশ্য চোখে পড়ে কম। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর ইতিহাস বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে। সেই নদীর দিকেও তাকানো যায় না। সরু তো হয়েছেই, দিন দিন আবর্জনা ও বর্জ্য পড়ে দূষণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। পানি হয়েছে কালো। রাজশাহীতে পদ্মা, বগুড়া অঞ্চলে যমুনা করতোয়া বাঙালী, বৃহত্তর রংপুরে তিস্তা ধরলা, চাঁদপুরে মেঘনাসহ সকল নদী নাব্য হারিয়েছে। চর জেগে ভরাট হচ্ছে। ছোট নদীগুলোর অস্তিত্ব ধরে রেখেছে শুকনোর ওপর ব্রিজের গায়ে লেখা নদীর নাম। ক’দিন আগে ভারতের কলকাতার একটি সাংস্কৃতিক দল বাংলাদেশে এসে বুড়িগঙ্গা দেখে বললেন, কলকাতাতেও গঙ্গার একই দশা। নদী বাঁচিয়ে এই ধরিত্রীর মানুষকে রক্ষার আকুতি জানাতে তারা মাঠে নেমেছে। তাদের গোষ্ঠীর নাম অরবিন্দ মিউজিক। প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধার ডা. জগন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষকে যত সহজে দ্রুত সচেতন করা যায় অন্য মাধ্যম তা পারে না। সংস্কৃতির রূপাতীত ধারা নিয়ে কাজ করছেন কলকাতার শিক্ষক ড. রোমী দাসগুপ্তা। বললেন বাংলাদেশ ও ভারত মৈত্রীর বন্ধনে থেকে প্রকৃতি রক্ষায় একযোগে সংস্কৃতির ধারাকে সঙ্গে নিয়ে জনসচেতনতায় নামতে পারে। বিশ্বের বিজ্ঞানীরাও নিকট ভবিষ্যতে সুপেয় পানির জন্য চিন্তিত। এক অধ্যাপক বললেন, যদি কখনও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয় তবে তা খাবার পানি নিয়েই লেগে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এ্যারোনটিক্স এ্যান্ড স্পেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই দেখছে জলের আধার আছে কি না! যেখানে পানি নেই সেখানে প্রাণের অস্তিত্বও নেই। পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দনের সৃষ্টি টিকিয়ে রাখতে যে পানির আধার মানুষই তা কলুষিত করে ফেলছে। উন্নত বিশ্ব মহাসমুদ্র বক্ষে চালাচ্ছে পারমাণবিক পরীক্ষা। আর উন্নয়নশীল দেশগুলো চোখের সামনেই নদীর মৃত্যু দেখেও কিছু করতে পারছে না। বিশ্বের মুরব্বিরা বলছে জলবায়ুর পরিবর্তন। গরিব দেশগুলো তাই মেনে নিচ্ছে। ভূগোলের হিসাবে পৃথিবীতে তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। তারপরও পৃথিবী বাঁচাতে পানি সম্পদ রক্ষা করতে হচ্ছে। ভারতের অরবিন্দ মিউজিক কলেজ বিশ্বের সকল মানুষের কল্যাণে নদী বাঁচানোর আবেদনকে সাংস্কৃতিক ধারায় যুক্ত করেছে। তারা বাংলাদেশে মঞ্চস্থ করেছে ডা. জগন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় পৌরণিক আদলে নৃত্যনাট্যের ফর্মে রূপক নাটক ‘কলুষ নাশিনী’। যা বগুড়া শহীদ টিটু মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয়। পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন ধরে রাখার আকুতির গঙ্গা নদীর প্রতীকী চরিত্রে ড. রোমী দাসগুপ্তা অভিনয় ও নৃত্যে বুঝিয়ে দিলেন নদীকে রক্ষা না করলে মানবসভ্যতা টিকবে না। ড. রোমী বললেন ‘শিল্পের ভুবনকে মানুষের কল্যাণে নিয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়েছি আমরা। পরীক্ষামূলকভাবে অনেক কিছুই করা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে।’ ড. রোমী দাসগুপ্তা রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবী, চিত্রাঙ্গদা, শাপ মোচন নৃত্যনাট্যকে রূপাতীত ধারায় এগিয়ে নিচ্ছেন। নদী রক্ষার এই নাটকে বক্তব্যের গাঁথুনিকে ধরে রাখতে গঙ্গা ও মহীতোষের প্রেমের উপাখ্যানে নদীকে যখনই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তখনই গঙ্গা নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে প্রেমের বিসর্জনে বিশ্বকে রক্ষা করেছে। গল্পের বিন্যাসে- কপিল মুনির অভিশাপে সগর রাজের সন্তানরা যখন মৃত তখন ঐশ্বীবাণী আসে, স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্তে আনলেই কেবল রক্ষা পাবে। ভগীরথের আহ্বানে গঙ্গা সঙ্গী যমুনাকে সঙ্গে নিয়ে আসে। রক্ষা পায় মর্ত্য। রূপক অর্থের সগর রাজ ধরিত্রী আর সন্তানরা বিশ্বের মানুষ। বিশ্বভারতীর সঙ্গীত শিক্ষক ড. মনোজ রায় বললেন, ‘মানব দেহের হৃদ স্পন্দনের জন্য যেমন দরকার রক্তের প্রবাহ তেমনই বিশ্বের হৃদ স্পন্দনেও দরকার জল।’ এমন সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে কাজ করছেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক ড. দেবাশীষ ম-ল, ড. মহাতাব, শ্রীমতী নিবেদিতা লাহিড়ী, রণজয় ব্যানার্জী আচার্য শঙ্কর, তনুশ্রী মিত্র ও অনুশ্রী মিত্র। শিল্পী কলাকুশলীরা বললেন, তারা আশা করে মৈত্রী ও সম্প্রীতির বন্ধনে বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীরা মানব কল্যাণে প্রকৃতি রক্ষায় একযোগে কাজ করবে। ডা. জগন্ময় বললেন ‘ভৌগোলিকভাবে আমরা দু’দেশের মানুষ। হৃদয়ের বাংলা ভাষায় আমাদের অনুভূতি একই।’ ড. মনোজের কথা নদী যে দেশেই বয়ে যাক নদীকে বাঁচিয়ে রাখলে আগামী পৃথিবী বাঁচবে। বিশ্বের মানুষ এখন নদী রক্ষার নানা কর্মসূচী গ্রহণ করে তা বাস্তবায়িত করছে। বাংলাদেশের অনেক নদীর নাম পাঠ্যপুস্তকে আছে। বাস্তবে বড় নদী ছাড়া অনেক ছোট নদীর অস্তিত্ব নেই। শুকিয়ে তা মরা গাঙে পরিণত। নদীর নাব্য রক্ষা না করায় বড় নদীগুলোরও বেহাল অবস্থা। শুকনো মৌসুমে যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চর। নদীগুলো ভর বছর পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকত। তাও দিন দিন কমে আসছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাংস্কৃতিক কর্মীরা নদী ও পরিবেশ রক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকা- নিয়ে বিশ্বের সকল দেশে যাচ্ছে। আকুতি জানাচ্ছে সকল দেশই এভাবে এগিয়ে আসুক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নদীর গানের কথা ‘...আমার চলা যায় না বলা আলোর পানে প্রাণের চলা/ আকাশ বোঝে আনন্দ তার...’ আলোর পানে এই চলাকে ধরে রাখার দায়িত্ব মানুষেরই।

No comments

Powered by Blogger.