অর্থনৈতিক অর্জন-সম্ভাবনার হাতছানি নতুন বছরে by আবুল কাশেম

দেশে সুশাসন নেই। সব কিছু দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। অর্থনীতির সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করছে সংঘাতময় রাজনীতি। জ্বালানি ও অবকাঠামো সংকটের কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন ঘনকালো চেহারাই ভেসে ওঠে অর্থনীতিবিদদের কথা শুনলে।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে কত অসম্ভব সম্ভব হয়ে গেছে, আরো কত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে- তা যেন প্রথম জানা গেল বিদেশি কিছু সংস্থা ও পত্রিকার বরাতে। বিদেশিদের নিন্দা ও স্তব সমান গুরুত্ব পায় এ দেশে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে যখন বিশ্বব্যাংক 'অমীমাংসিত বিস্ময়' বলে উল্লেখ করল, তখন দেশের চরম নৈরাশ্যবাদীরাও অর্থনীতির নানা উপাত্ত ঘেঁটে নানা নাটকীয় পরিবর্তন আবিষ্কার করছে। খুঁজছে নানা সম্ভাবনার ইঙ্গিত। একই সঙ্গে তারা অবশ্য সতর্ক করে দিয়েছে, এসব অর্জন কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের। সরকারের খুব বেশি কৃতিত্ব নেওয়ার বা আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কিছু নেই। সরকার যদি সহযোগীর ভূমিকায় থাকতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এসব অর্জন ধরে রাখা যাবে না।
সামষ্টিক অর্থনীতির দিক থেকে ২০১২ সাল ভালোই কেটেছে বাংলাদেশের। বিশ্বমন্দার মধ্যেও রপ্তানি খাতে সামান্যতম হলেও প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ। বছরের প্রথম দিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলেও শেষ প্রান্তে এসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নেমেছে। বছর শেষে টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, কমেছে আমদানি ব্যয়। এতে স্বস্তি যেমন আছে, উদ্বেগও কম নয়। কারণ বিনিয়োগ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ভাটা পড়েছে, যার কারণে অদূর ভবিষ্যতে উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে। কয়েক দফায় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় জীবন যাপনে চাপ বেড়েছে। তবে বিশ্বজুড়ে বড় ও দাপুটে অর্থনীতিগুলো যেখানে স্থবির হয়ে পড়েছে সেখানে বাংলাদেশের স্থিতিশীল অর্থনীতির চেহারাটাই বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার চাপে নুয়ে পড়া বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাংক ছাড়াও দি ইকোনমিস্ট এবং গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকাও বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে।
সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিকে বিদায়ী বছর স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বিদায়ী বছরের প্রথম দিন থেকে গত ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ মাস ১৪ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ হাজার ৫৩২ মিলিয়ন ডলার। আর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি হয়েছে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮৯ জন। গত বছর প্রবাসীরা ১২.১৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। একদিকে যেমন রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি ও আমদানি নিরুৎসাহিত করতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশে পণ্য আমদানির ব্যয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পৌনে সাত শতাংশ কমেছে। এতে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে পণ্য আমদানি বাবদ এক হাজার ৯৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের একই সময় এক হাজার ১৭৬ কোটি ৫৬ লাখ ডলার ব্যয় করতে হয়েছিল।
রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি না ঘটলেও আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানা আর উচ্চহারে রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে বছরের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ রিজার্ভ রয়েছে সরকারের হাতে। গত ২০ ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে বাংলাদেশের পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি আয় করা সম্ভব না হলেও গতবারের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে। এই সময় রপ্তানি খাতে যেটুকু প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে, অন্য বছরের তুলনায় তা কম মনে হলেও বিশ্বমন্দার প্রেক্ষাপটে তা বেশ সন্তোষজনকই মনে হয়। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ২০১২-১৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয় বেড়েছে ৪.৩৬ শতাংশ, যার পরিমাণ ৯৭১ কোটি ডলার। এই সময় এক হাজার ৬৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে এক হাজার ১৩ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। মাসের হিসাবেও নভেম্বরে রপ্তানি আয় ১১ শতাংশ বেড়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
গত এক বছরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সরকার কল-কারখানায় নতুন সংযোগ দেওয়া শুরু করেনি। নতুন করে গ্যাস সংযোগও বন্ধ। ফলে অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচিত নতুন বিনিয়োগ তেমন হয়নি গেল বছর। বিনিয়োগ বোর্ডের সাময়িক হিসাবে, ২০১২ সালে এক হাজার ৬০১টি প্রকল্পে বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ চার লাখ ৯৮ হাজার ১৮৭ মিলিয়ন টাকা এবং কর্মসংস্থান তিন লাখ ৯ হাজার ৭৯৯ জন। ২০১১ সালে এক হাজার ৯৭৪টি প্রকল্পে নিবন্ধনের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৩১ হাজার ৭৫ কোটি মিলিয়ন টাকা এবং সম্ভাব্য কর্মসংস্থান হিসাব করা হয় পাঁচ লাখ তিন হাজার ৯৮৩ জন। বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি মনে করে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী তাঁদের নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারছেন না। সে কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এখন হুমকির মুখে। জমির অভাব শিল্প স্থাপনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প পার্ক ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ঘোষণা বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বমন্দা, অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত সংকট সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধিতে অর্ধেক অবদান রাখা বাংলাদেশের সেবা খাত ভালোই কাটিয়েছে ২০১২ সাল। এর পাশাপাশি কৃষি খাতে উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় বেশ বেড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএসের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হচ্ছে। যদিও বাজেটে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত ২২ অক্টোবর 'বাংলাদেশ ইকোনমিক আপডেট' প্রকাশ করার সময় বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিশ্বমন্দা বিশেষত ইউরো অঞ্চলের সংকট, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ বিভিন্ন ঝুঁকির কারণে প্রবৃদ্ধির এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। ৬ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি হবে বলে মনে করে তারা।
এদিকে বছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতির যে উল্লম্ফন ছিল, বছর শেষে তা সহনীয় হয়ে আসে। জানুয়ারি মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১.৫৯ শতাংশে। তবে নভেম্বরে এসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার হয় ৬.৫৫ শতাংশ। ২০১২ সালে মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের ভিত্তি বছর পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে ১৯৯৫-৯৬ ভিত্তি বছর ধরা হলেও এখন ২০০৫-২০০৬ বছর ধরা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় সাধারণ মানুষের কষ্ট কম হয়। এর পেছনে মূল ভূমিকা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসৃত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। আইএমএফের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা পাওয়ার জন্য কর আইন সংস্কার, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ সীমা তুলে নেওয়ার পাশাপাশি সরকার জ্বালানিতে বিপুল ভর্তুকি সমন্বয় করার জন্য বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়িয়েছে। বছরের শেষ সপ্তাহে আরো ৫ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। এসব কারণে বিনিয়োগ কমছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, 'বিশ্বব্যাংক বলছে বলেই নয়, অনেক আগে থেকেই আমরা বলে আসছি এ দেশের অর্থনীতি চালিয়ে রেখেছে শ্রমজীবী মানুষ। পোশাক খাতের দক্ষ ও স্বল্প আয়ের শ্রমিকরা দেশে আনছেন ১৯ বিলিয়ন (এক হাজার ৯০০ কোটি) ডলার, যা দেশের রপ্তানি আয়ের ৭৫ শতাংশ। আর ৮০ লাখ প্রবাসী শ্রমিক দেশে পাঠাচ্ছেন বছরে ১৩ বিলিয়ন ডলার।' অথচ আইএমএফের কাছ থেকে তিন বছরে মাত্র এক বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার পাওয়ার আশায় সরকার বিনিয়োগ সংকোচনের নীতি অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, 'রপ্তানি, রেমিট্যান্সসহ আরো নানা দিকে সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দরকার মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বয়, বিনিয়োগে প্রণোদনা, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সুদের হার কমানো। এমন নীতি অনুসরণ করতে হবে যাতে দেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ে। কুইক রেন্টালের মতো ব্যয়বহুল ও সাময়িক বন্দোবস্ত ছেড়ে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নিতে হবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাসান জামান বলেন, 'ইইউতে সংকট আমাদের রপ্তানি খাতের জন্য একটা উদ্বেগের কারণ। সমাধান না হলে ইউএসএর ফিসক্যাল ক্লিফও আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।'
ড. তিতুমীর বলেন, 'রাজনৈতিক সংঘাত বড় বাধা নয়। অপার সম্ভাবনার এ দেশের জন্য দরকার সৃজনশীল অর্থনৈতিক নীতি। তাহলেই আমরা এগিয়ে যাব।'aaaaax

No comments

Powered by Blogger.