রেল কেলেঙ্কারি by মহিউদ্দিন আহমেদ

গেল বছরের কয়েকটি আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম ছিল রেল কেলেঙ্কারির বিষয়টি। তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুক তালুকদার বস্তাভর্তি ৭০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়িসহ ধরা পড়েন বিজিবি সদর দফতরে।
ঘটনার পর গাড়ি চালক আলী আজম গণমাধ্যমকে জানান টাকা রেলমন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিল। একই সময়ে সুরঞ্জিতপুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত বিটিআরসি থেকে ‘আইসিএক্স’ (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) লাইসেন্সের অনুমোদন পান। কথা উঠে বাবা সেনগুপ্তের দুর্নীতির টাকায় ছেলে আইসিএক্সের লাইসেন্স নিয়েছেন।
এমন অবস্থায় রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা হয়ে পড়েন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি। তাঁর ৫৫ বছরের নৈতিকতার রাজনীতি প্রশ্নবৃদ্ধ হয়ে উঠে জনমনে। তবে শেষ পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন ও রেলমন্ত্রণালয়ের তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।
তৎকালীন রেলমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুক তালুকদার, রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেলের নিরাপত্তা কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে নিয়ে ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতে এপিএসের ব্যক্তিগত গাড়ি চালক আলী আজম খান গাড়ি হঠাৎ বিজিবি সদর দফতরে ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। গাড়ি ঢুকানোর পর গাড়ি চালক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। কর্তব্যরত বিজিবি সদস্যরা গাড়ি তল্লাশি করে দেখতে পায় গাড়ির ভেতর বস্তাভর্তি টাকা। টাকার পরিমাণ ৭০ লাখ টাকার অধিক। এ ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই টাকা সুরঞ্জিত সেনের বাসায় নেয়া হচ্ছিল বলে বেসরকারী টেলিভিশনে বক্তব্য প্রদান করেন ফারুকের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলী আজম খান। এমন বক্তব্য দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর বর্ষীয়ান রাজনৈতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ঘটনার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টা নেই বলে দাবি করার পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুক, পূর্বাঞ্চল রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা এবং এনামুল তিন জনকে নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত করা হয়। রহস্যজনক বিষয় হচ্ছে ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যান গাড়িচালক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনুসন্ধান, দুদক ও রেলমন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও তাকে খুঁজে পায়নি। এক পর্যায় রেলমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে রেলের অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। কথা অনুযায়ী তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিতের পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে রাখেন। তবুও ৫৫ বছর ধরে নৈতিকতার সঙ্গে যে রাজনীতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত করে আসেন সে বিষয়টি নিয়ে জনমনে উঠা প্রশ্ন থেকে যায়। তাছাড়া তিনি রেলমন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পর ঘোষণা দেন রেলের কালো বিড়াল বের করেন ছাড়বেন। যখন তার এপিএস ৭০ লাখ টাকা নিয়ে ধরা পড়েন তখন সেই কালো বিড়ালের মালিক হিসেবে গণমাধ্যমে তার নামটি ওঠে আসে। তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার জন্য একটি গ্রুপ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে বলে তিনিসহ তাঁর ঘনিষ্ঠরা দাবি করেন। বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি ছিল ঘটনাটি সাজানো না হলে গাড়িচালক কেন বিজিবি সদর দফতরে প্রবেশ করবে? ওই সময় বিজিবি সদর দফতরের প্রধান দরজা বা কেন খোলা থাকবে? পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং ডেসটিনি গ্রুপের হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি যখন টক অব দ্য কান্ট্রি তখন হঠাৎ করে একটি বেসরকারী টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা ফারুকের গাড়িচালক আলী আজমের ইন্টারভিউ। তখন ঘটনাটি যারা ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন তাদের যুক্তি আরও জোরালো হয়। তবে বেসরকারী টেলিভিশনের সম্প্রচার হওয়া ইন্টারভিউতে গাড়িচালক আগের মতো দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন ওই টাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় নেয়ার জন্য তাকে বলা হয়েছিল। তিনি বিবেকের তাড়নায় গাড়িটি বিজিবি সদর দফতরে ঢুকিয়ে দেন।
ঘটনাটি ঘটার তিন দিন পর ১২ এপ্রিল প্রকৃত ঘটনা অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশন দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে। অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় উপ-পরিচালক মোঃ আবু সাঈদ ও সহকারী পরিচালক রাশেদুর রেজাকে। দায়িত্ব পাওয়ার পর কমিটি এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে ফারুক, মৃধা এবং এনামুলকে তলব করে। তিনজনই ওইদিন দুদক কার্যালয়ে নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ সময় ফারুক ৭০ লাখ টাকা নিজের বলে দাবি করেন। মৃধা এবং এনামুল ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন। এ ছাড়া তাদের ব্যক্তি সম্পদের বিষয়েও মৌখিকভাবে জানতে চায় অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। দুদকের কাছে তিনজনই নিজেদের সম্পদ এবং সম্পদের উৎসের ব্যাখ্যা দেন। একই ঘটনায় তদন্ত কমিটি ২৫ তারিখ তলব করেন ইউসুফ আলী মৃধার ব্যক্তিগত গাড়ি চালককেও। তিনি দুদকের কাছে নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ফারুকের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলী আজমকেও দুদকে ডাকা হয়। কিন্তু তিনি নিখোঁজ থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে রেলের নিয়োগ সংক্রান্ত সকল নথিপত্র জব্দ করে দুদকের অনুসন্ধান কমিটি। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং রেলের নিয়োগ সংক্রান্ত নথিপত্র ক্ষতিয়ে দেখে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখে দুর্নীতি দমন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিকট জমা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায় ৭০ লাখ টাকার ঘটনা এবং রেলের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সংশ্লিষ্টতার আছে এমন কোন বক্তব্য ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বক্তব্যে উঠে আসেনি। যাতে এ ঘটনায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অবস্থান থেকে সরে আসে দুদক। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ফারুক, মৃধা এবং এনামুলের অনিয়মের আলামত ধরা পড়ে। ওই ৭০ লাখ টাকা ফারুক নিজের দাবি করলেও টাকার সঠিক উৎস তিনি দুদকের কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হন। যার কারণে বিদায়ী রেলমন্ত্রীর বরখাস্ত এপিএস ওমর ফারুক, রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার (বরখাস্ত হওয়া) ইউসুফ আলী মৃধা ও তার স্ত্রী রেলের (বরখাস্ত) নিরাপত্তা কমান্ড্যান্ট এনামুল হক এবং তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাব নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করে সংস্থাটি। এর মধ্যে ফারুক কারাগারে আছেন। অপর দুই আসামি পালাতক রয়েছেন। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চল রেলের ২৬ ক্যাটাগরির নিয়োগের পৃথক তদন্ত শুরু করে দুদক। এর মধ্যে ছয়টি ক্যাটাগির নিয়োগে দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে ইউসুফ আলী মৃধা, নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান এবং সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে। বাকি কয়টি ক্যাটাগরির নিয়োগ বাণিজ্যেও বিষয়টি দুদকের অনুসন্ধানাধীন রয়েছে।
অন্যদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তের (বিটিআরসি) থেকে ‘আইসিএক্স’ (ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ) লাইসেন্স পাওয়ার অর্থের উৎস জানতে ১৬ এপ্রিল দুর্নীতি দমন কমিশন ঘটনাটি অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য কমিশনের কর্মকর্তা আখতার হামিদ ভূঁইয়াকে অনুসন্ধান কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়। ২৬ এপ্রিল তদন্ত কর্মকর্তা সৌমেনকে জিজ্ঞাসা করে। সৌমেন বৈধ টাকায় লাইসেন্স পেয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগটি নথিভুক্ত করে দুদক।

No comments

Powered by Blogger.