জীবন কথন- শ্রমজীবীর ভ্রমণকথা- রণজিৎ বিশ্বাস

মেয়েটি আমাকে অবাক করেই ছাড়ল। এত পরিশ্রমী ও এত গুছানো, সাহসী ও ঠাণ্ডা মাথার মেয়েটি কি আমার মেয়ে! বাড়িতে কোনদিন তাকে আমি রান্নাঘরে ঢুকতে দেখিনি।
কিন্তু, টরন্টোয় পড়া, অবসরে ফুড স্টোরে চাকরি করা, তারপর বাসায় ফিরে রেঁধেবেড়ে খেতে খেতে সে অন্য মানুষ; ভুল, ভুলের পরে শুদ্ধ আর শুদ্ধ করার পরে আবার ভুল কিংবা অর্ধভুল করার গবেষণায় মেতে মেতে কিছু রান্না সে শিখে ফেলেছে। ততদিনে মাছ, মাংস, ডিম তো রান্না করতে সে পারেই, আমার পছন্দের খাদ্যগুলো বেশি পারে।
যা এক সময় প্রচুর ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেয়ে খেয়ে শরীরটাকে শেষ করেছি; সর্বপ্রকার মাছ, সর্বপ্রকার মাংস ও সর্বপ্রকার ডিম্ব; আমি এখন আর খেতে পারি না, আমাকে টানেই না আর, যেন খাওয়ার কোটা শেষ হয়ে গেছে। এখন আমার দেহে প্রোটিনের ইনটেইক হয় শুধু মুরগির ডিম দিয়ে- কখনও অমলিট, কখনও ফ্রাই, বিশেষত দু’পাশ ওল্টানো টার্নওভার ফ্রাই, কখনও শুধু বয়েলড এগ, কখনও পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কার সঙ্গে বয়েলড এগ দলেকচলে সর্ষে তেলের সঙ্গে মিশিয়ে বাঙালী স্টাইলের ভর্তা, সোজাশাপটা কথায় ডিমভর্তা।
ইদানীং আমার রাজভোগ হয়ে যাচ্ছে যদি পেয়ে যাই চিকন চালের গরমভাতের সঙ্গে ডবল ডিমের অমলিট, এপাশ-ওপাশ উল্টেপাল্টে কড়া ভাজা, চাকাচাকা বেগুন ভাজা, ফালাফালা কাঁকরল ভাজা, পোড়াপোড়া আলুভাজা, ঝালঝাল আলুভর্তা, সঙ্গে অবশ্যই টমেটো সহযোগে রান্না করা উত্তমরূপে গলানো মশুর ডাল। মেয়েটি আমাকে তার সকল ব্যস্ততার মাঝেও অদলবদল করে এ মেন্যুতে সে মেন্যুতে সব ক’টিই রেঁধে খাইয়েছে। খেতে খেতে আমি ভেবেছি-যাক, সে তার মা’র মতো হয়নি।
: খুব সাধারণ খাবার সবই, তবে আপনি যেভাবে বর্ণনা দিলেন স্যার, আমার কাছে সবই খুব মাউথ-ওয়াটারিং মনে হচ্ছে। যদিও দু’জনই আমরা খুব মাংসভোজী। প্রতিবেলায় একটি না হয় দু’টি প্রাণীজ প্রোটিন না হলে আমাদের চলে না।
:তোমরা ইয়াং মানুষরা তো মাংসভোজী হবেই! খুবই স্বাভাবিক! ছেলেটি প্রথম আমাকে, হঠাৎ করেই, স্যার ডেকে বসল। খারাপ লাগল না আমার। আঙ্কেল ও কাকাবাবু কিংবা জেঠামশাই জাতীয় ডাক আমার ভাল লাগে না। তার প্রোটিনপ্রীতির সূত্র ধরে বললাম- : প্রোটিন তোমাদের লাগবেও বালক। তোমাকে বালক ডেকে বসলাম, কিছু মনে করো না। তুমি মিলিটারি মানুষ, তোমার স্ত্রীও ইয়াং, কিছু জান্তব কারণে তোমাদের এখন এ্যানিমেল প্রোটিন ইনটেইক করতেই হবে। নইলে ঠকে যাবে। আমরাও করতাম। : ঠিক আছে স্যার। বালক সম্বোধনটা আমার বেশ ভালই লাগছে। আমি বেশ এনজয় করছি। আমার স্কুল মাস্টার বাবারও এই অভ্যাসটা আছে। কেন তিনি হেডমাস্টার হয়ে বসে আছেন এক শ’ বছরের পুরনো একটি স্কুলের, চল্লিশের নিচের কাউকে তিনি বালক ছাড়া ভাবতেই পারেন না। আমি আর আমার মা কত বকাঝকা যে ওকে করি, কিন্তু কোন কাজ হয় না। বাই দ্য বাই স্যার, আপনার সঙ্গে আপনার মেয়ের অ্যাটাচমেন্টটা খুব বেশি মনে হচ্ছে!
: দেখ বালক, তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় বল আর দেখাসাক্ষাত বল, মাত্র চার-পাঁচ দিনের। আমি এখানে আরও দশবারো দিন আছি; আমি বললে প্রতিদিন বিকেলে এই মেইন স্টেশনের কাছের ‘টিম হর্টনস’ রেস্তরাঁয় তুমি আমার ‘কফিসঙ্গী’ হবে কিনা আমি জানি না। এলে খুশি হবো, না এলেও আমি নিরাশ হবো না। এগুলো এ জীবনে খুব স্বাভাবিক। তোমার বয়সে আমিও হয়ত পারতাম না।
: না স্যার, আমি আসব। আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালই লাগছে। আমিও এখানে দশবারো দিনের বেশি নেই। যতদিন আছি, খুব বেকায়দায় না পড়লে অথবা আমার ওয়াইফের সঙ্গে খুব জরুরী কোন অ্যাঙ্গেজমেন্টে জড়িয়ে না পড়লে আপনার সঙ্গে বিকেলবেলা, চার-সাড়ে চারটার দিকে আমার দেখা হবে। আমার স্ত্রীকেও আপনার কথা বলেছি। সে খুব চার্জড হয়ে বসে আছে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
: মন্দ কি! দেখা করিয়ে দাওনা একদিন। আমার তো মনে হয়, সে আমার মেয়ের বয়েসীই হবে।
: আপনার মেয়ের বয়স এখন কত? বাবা বলে আপনাকে জিজ্ঞেস করতে সাহস করলাম, সরাসরি ওকে কখনও জিজ্ঞেস করার সাহস আমি দেখাতে পারতাম না।
: খুবই স্বাভাবিক! কারও বয়স কখনও সরাসরি জিজ্ঞেস করতে নেই। মেয়েদের তো নয়ই! মার খাওয়ার ভয় না থাকলে অবশ্য অন্য কথা। ওয়েল, আমার মেয়ের জন্ম উনিশ শ’ ছিয়াশি সালে, এখন তার বয়স ও শতাব্দীতে চৌদ্দ, এ শতাব্দীতে বারো, মোট ছাব্বিশ।
: একটু থামুন। কি বললেন আপনি স্যার! ছাব্বিশ! তাহলে আমি বলব, মিরাকল অ্যান্ড কো-ইনসিডেন্স স্টিল হ্যাপেনস! আমার বউয়ের জন্মদিনও ছিয়াশিতে পড়েছে, উনিশ শ’ ছিয়াশিতে। বাই দ্য বাই, আপনার মেয়ের জন্মদিনটা মনে আছে?
: কি যে বল বালক! আমার স্ত্রীর জন্মদিন কখনই আমার মনে থাকে না, নিজের জন্মদিন আর বিয়ের দিনও আমি কখনও কখনও ভুলে যাই, আমার স্ত্রী যে কেমন রাগ করে তখন, যদি তোমাকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারতাম খুব ভাল হতো। তা তো আমি পারব না বালক। আমার বাবা আর মা, যারা দু’বছরের ব্যবধানে মারা যাওয়ার পর আমার একবার মনে হয়েছিল-জীবনের অর্ধেকেরও বেশি অন্ধকার হয়ে গেলো। আরেকবার মনে হয়েছিল আমার জীবনের কোন মানে নেই, আমি এক ব্যর্থসন্তান; তাদেরও মৃত্যুদিন আমি হারিয়ে ফেলেছি। বিস্মৃতিপরায়ণ এই বৃদ্ধের মনে নেই সেই বিশেষ দু’টি দিনের কথাও। আমি খুব অবাক হই, নিজেকে নিজে আমি খুব বকাবকি করি। অদম্য এই বিস্মৃতিপরায়ণতার জন্য নিজেকে আমি বড় ক্ষুদ্র ও খর্ব মনে করি। যাহোক, তুমি আমার মেয়ের জন্মদিন জানতে চাচ্ছিলে। নয়ই সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। : আমার স্ত্রীর জন্মদিন সাতই সেপ্টেম্বর। আপনার মেয়ের চেয়ে সে তাহলে দু’দিনের বড়। অ্যাগেইন ভেরি ইন্টারেস্টিং। আপনি যাই বলুন স্যার, এই মিলগুলো কিন্তু আমাকে খুব অবাক করে দিচ্ছে! [কথা চলবে]।

No comments

Powered by Blogger.