আলোচনায় ছিল দুদক by মহিউদ্দিন আহমেদ

বিগত ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এক আতঙ্কের নাম ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই সময়ে এ সংস্থাটির নাম শুনলে বর্ষীয়ান রাজনৈতিক, বাঘা আমলা ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা আঁৎকে উঠতেন।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার পুরনো চেহারায় ফিরে যায় দুদক। কিন্তু বিদায়ী ২০১২ সালে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি গ্রুপের অর্থ আত্মসাৎ, পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র ও রেল কেলেঙ্কারির ঘটনায় আসামিদের গ্রেফতার করে চলতি বছর পুনরায় আলোচনায় উঠে আসে সংস্থাটি। তবে গত নবেম্বরে কোকোর ২০ লাখ ডলার দেশে ফেরত এনে সবচেয়ে বেশি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
এ সময়ে দুদক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব ও মন্ত্রীপুত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় নিয়ে আসে। একই সঙ্গে সাবেক সেনা কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করে। এছাড়া প্রথমবার আরাফাত রহমান কোকোর বিদেশ থেকে ঘুষের টাকা ফেরত আনে দুদক। তবে দুদককে ঘিরে সমালোচনাও কম হয়নি। প্রধান বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের কতক ব্যক্তি প্রায়ই বলে সরকার সংস্থাটিকে বিরোধী দল দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে ২০০৪ সালের ২১ নবেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে বিলুপ্ত করে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সরকারের সময়ে কৌশলে দুদককে অকার্যকর করে রাখার অভিযোগ আছে। এর মধ্যে বিগত ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এক রকম দুর্নীতির জিহাদ ঘোষণা করে সংস্থাটি। বর্তমান ও সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করে দুদক। তবে তখনকার দুদকের কর্মকা- নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক রয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার এক রকম অকার্যকর করে রাখা হয় দুর্নীতি দমনের সরকারী এ সংস্থাকে। এমন অবস্থায় তৎকালীন রেলমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী ওমর ফারুক তালুকদার, রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার ইউসুফ আলী মৃধা এবং রেলের নিরাপত্তা কমান্ড্যান্ট এনামুল হককে নিয়ে ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতে এপিএসের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলী আজম খান গাড়ি হঠাৎ বিজিবি সদর দফতরের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। কর্তব্যরত বিজিবি সদস্যরা গাড়ি তল্লাশি করে দেখতে পান গাড়ির ভেতর বস্তাভর্তি ৭০ লাখ টাকার অধিক। এ ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই টাকা সুরঞ্জিত সেনের বাসায় নেয়া হচ্ছিল বলে বেসরকারী টেলিভিশনে বক্তব্য প্রদান করেন ফারুকের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আলী আজম খান। তখন দুদক আলোচিত ঘটনা অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধান পর্যায়ে তারা অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে অপর একটি ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় মন্ত্রীপুত্র সৌমেন সেনগুপ্তকে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীপুত্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় দুদক। এর মধ্যে পদ্মা সেতু পরামর্শক যাচাইতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। স্বপ্রণোদিত হয়ে এ অভিযোগটি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তখন এ কাজটি দেশ-বিদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। দুর্নীতি দমন কমিশন এ ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য নূরে আলম চৌধুরীর ছোট ভাই প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নিক্সন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসে দুদক কার্যালয়ে। একই ঘটনায় ইতোমধ্যে সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও তিনজন কানাডিয়ান নাগরিকসহ ৭ জনকে আসামি করে মামলাও করেছেন। মামলার এজাহারে সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে আবুল হোসেন ও আবুল হাসানের নামও রাখা হয়। দেশের শীর্ষ এমএলএম ব্যবসা ডেসটিনি গ্রুপের বেআইনী ব্যবসা এবং গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতারণা করে অর্থ নেয়ার অভিযোগ অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের করে দেশব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে।
অর্ধ কোটি গ্রাহকের এ এমএলএম কোম্পানির চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল আমীন, সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর রশীদসহ ৫ জনকে কারাগারে যেতে হয় দুদকের মামলায়। যদিও বর্তমানে জেনারেল (অব) হারুন শর্তসাপেক্ষে জামিনে রয়েছেন। দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে বড় অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনাটি ধরা পড়ে ২০১২ সালে। হলমার্ক গ্রুপ নামে একটি গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে নিয়ম ভেঙ্গে এলসি ও আইবিপির মাধ্যমে তুলে নেয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর এ বিষয়টি তদন্তে মাঠে নামে দুদক। প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতায় ঘটনাটি ঘটে বলে সংবাদ প্রচার হয়। তখন সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল সরকারে প্রভাবশালীদের নাম যেহেতেু এসেছে সেহেতু ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু সে রকম না ঘটে হলমার্ক গ্রুপ এবং সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মিলে ২৭ জনকে আসামি করে ১১টি মামলা দয়ের করে দুদক। মামলার পর গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, এমডি তানভীর মাহমুদ, জিএম তুষার আহমেদ এবং সোনালী ব্যাংকের চার কর্মকর্তাসহ ৭ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
আরেক আলোড়ন সৃষ্টি করে নবেম্বর মাসের ১৮ তারিখে সিঙ্গাপুর থেকে কোকোর ঘুষের অর্থ ফেরত এনে। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী প্রয়াত আকবর হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সায়মন সিঙ্গাপুর ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকে একটি হিসাব খুলে ঘুষ হিসেবে দেশের বাইরের কয়েকটি কোম্পানি থেকে মুদ্রা আদায় করে। ওই মুদ্রার ২০ লাখ ৪১ হাজার সিঙ্গপুরী ডলার দেশে আনতে সক্ষম হয় দুদক। ২০০৯ সালে দুদকের দায়ের করা এক মামলার প্রেক্ষিতে ওই মুদ্রা ফেরত আনা হয়।

No comments

Powered by Blogger.