ইতিহাস নির্মাণে নারীর ভূমিকা by নীলুফার বেগম

৩১ মার্চ ২০১০-এ কর্নেল মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ বীরপ্রতীক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন বাহ্যিকভাবে কঠোর, অন্তরে কোমল, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, আত্মপ্রত্যয়ী, নিয়মনিষ্ঠ, নারী-পুরুষে সমতায় বিশ্বাসী ও নারীর অবদানের প্রতি নিরপেক্ষ সম্মানদাতা।
তিনি যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ওপর বেশ কয়েকটি বই লিখে গেছেন। বিশেষ করে, তাঁর 'মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারী' শীর্ষক বইটি উল্লেখযোগ্য। ওই বইয়ে তিনি লিখেছেন, 'যুদ্ধকালে আমাদের আশ্রয় দিয়ে কত মা-বোন যে নিজের জীবন দিয়েছেন, সয়েছেন অকথিত অত্যাচার, হারিয়েছেন সহায়সম্পদ-ইজ্জত' (পৃ. ৮)। সফিক উল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকালীন গ্রামেগঞ্জে নারীদের সাহায্য-সহযোগিতা ও আত্মত্যাগের যে অবদান দেখেছেন, সেসব ছিল তাঁর চোখে অতুলনীয়। তবে তাঁর মতে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীদের আত্মত্যাগের ও বীরত্বের কাহিনী প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে অব্যক্ত এবং তাঁরা কমবেশি উপেক্ষিত। তিনি তাঁর ওই বইয়ে লিখেছেন (পৃ. ৮), 'যত দিন ১৯৭১-এর যুদ্ধকালীন বাংলার মা-বোনের, যোদ্ধা নারীদের অবদান সংযোজিত না হবে, তত দিন মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাস থাকবে অপূর্ণ।' উপরন্তু তিনি বলেছেন, বাংলার নারীরা মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা না করলে স্বাধীনতা পেতে আমাদের আরো বিলম্ব হতো। সফিক উল্লাহর যুদ্ধজীবনের সূচনা হয় ঝিনাইদহে। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর বাসায় মুক্তির প্রাথমিক অস্ত্রাগার, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও আহারের স্থান ছিল। এ ব্যাপারে তাঁর স্ত্রী নাসিমা আক্তার পারভীনের ছিল সক্রিয় ও আন্তরিক ভূমিকা। তিনি ৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে কুষ্টিয়া দখলের মরণযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন তাঁর স্ত্রী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা (প্রথম সন্তান)। বাড়িতে আরো ছিল মৃত বড় ভাইয়ের তিনটি শিশুসন্তান। তাদের তিনি লেখাপড়া শেখাতেন। তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যুদ্ধ করেন। বিশেষ করে ঝিনাইদহ, যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, খুলনা ও ফরিদপুরের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। তাঁর যুদ্ধসাথি ছিলেন তৎকালীন ঝিনাইদহ পুলিশের এসডিপিও ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দিন আহমদ ও মেহেরপুরের এসডিও ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। ওই সব এলাকার মা-বোনেরা সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আহার, আশ্রয় ও যুদ্ধাহতদের শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেন। এ রকমই ছিল মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষের সংগ্রামী চেতনা।
মরহুম কর্নেল মোহাম্মদ সফিক উল্লাহর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৬ অক্টোবর কুমিল্লার চান্দিনা থানার কৈলাইন গ্রামে সম্ভ্রান্ত ও জমিদার পরিবারে। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরের 'ই' কম্পানিসহ ৫ নম্বর গেরিলা ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য 'বীরপ্রতীক' খেতাবেও ভূষিত হন। তিনি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি ইউটিসির সদস্য ছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে ছিলেন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের বাংলার অধ্যাপক। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সেনা সদর, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমী, ২৪ পদাতিক ডিভিশন এবং আর্মি স্কুল অব এডুকেশন অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি আইইউবিএটিতে ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা অন্তঃসত্ত্ব্বা স্ত্রী ও এতিম ছোট তিনটি বড় ভাইয়ের ছেলে রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলেন_তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তারপর বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তাঁর স্ত্রী ঝিনাইদহ থেকে ভাশুরের ছেলেদের নিয়ে নিজ জেলায় পেঁৗছান। এরপর যুদ্ধকালীন ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে তিনি একটি মেয়েসন্তান প্রসব করেন কুমিল্লা সিভিল হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা বোন জ্যোৎস্নার সহায়তায়। অকস্মাৎ যমদূত শেল আঘাত হানে হাসপাতালে। ৯ পাউন্ড ওজনের নবজাতক মেয়েটি ৪৪টি ছোট-বড় মাংসের টুকরায় পরিণত হয় (পৃ. ৩০)। সদ্যপ্রসূত একলামশিয়ার অচেতন মা ও মুক্তিযোদ্ধা বাবার অনুপস্থিতিতে নিয়তির এই খেলা। ব্যক্তিস্বার্থের ঊধর্ে্ব ওঠা ত্যাগী এই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল সফিক উল্লাহ বীরপ্রতীক চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন আপনজনের মধ্যে।
লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব

No comments

Powered by Blogger.