নতুন বছর-বাংলাদেশের জন্য শুভ হোক-২০১৩ by মোহীত উল আলম

বাংলাদেশে এখন ইতিবাচক আর নেতিবাচকের মাতামাতি চলছে। বিদেশি কয়েকটি সালতামামি প্রতিবেদন বাংলাদেশকে উন্নয়ন অর্জনকারী কয়েকটি দেশের মধ্যে অবস্থান দিয়েছে।
ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি জরিপে বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক সাফল্যে বর্তমানের চীন ও ভারতের পর্যায়ে পেঁৗছবে। বিদেশি জানালা দিয়ে দেখার দরকার নেই, টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে দেশের কৃষি ও শিক্ষার ওপর বিভিন্ন সচিত্র প্রতিবেদনে গ্রামাঞ্চলের যে চেহারাটা ফুটে ওঠে, তাতে মন আনন্দে ভরে ওঠে। পরিচিতজন যাদের গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তারা বলেন, 'গ্রাম ঘুরে আসেন, দেখবেন কী উন্নতি হয়েছে।' পত্রিকার রঙিন ছবিতে দেখি, টক বেগুনের দিগন্তজোড়া চাষ হচ্ছে। বাসায় সকালে প্রাতঃরাশে ভাপা পিঠা এলো, সঙ্গে খেজুরের খাঁটি রস। সুদূর বাঁশখালী থেকে এসেছে। জমিতে ফলন হচ্ছে শুধু তাই নয়, সে ফলনের চালানও হচ্ছে। অর্থাৎ যোগাযোগ ব্যবস্থাও তৈরি হয়েছে। স্কুলে পড়তাম, 'বাংলাদেশের কৃষক প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল।' অথচ টিভির একটি অনুষ্ঠানে দেখলাম, কোট-টাই পরিহিত একজন চশমাধারী যুবক কৃষক তার প্রান্তর বিস্তৃত ধানক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, কী কী উপায়ে তার জমিকে তিন ফসলা করেছেন ইত্যাদি।
কৃষির উন্নতির পাশাপাশি শিক্ষায় বাংলাদেশ সমীহ জাগানো উন্নতি লাভ করছে। স্কুলগুলোয় নিয়মানুবর্তিতা ও নিয়মিত হওয়ার ছাপ পড়েছে। আজকেই (১ জানুয়ারি, ২০১৩) শিশুরা স্কুলে যাবে খালি হাতে, কিন্তু ফিরবে বই হাতে। বছরের প্রথম দিনে নতুন বই হাতে পাওয়া শিশুদের চাঁদে পেঁৗছানোর মতো আনন্দ দেবে। তারপর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো দেশব্যাপী একই সময়সূচি ও একই প্রশ্নের আওতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে দেশব্যাপী শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদানের মধ্যে গণতান্ত্রিক সমতা তৈরি হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার পাদভূমি ঠিক হয়ে গেলে ওপরের স্তরের শিক্ষার বেলায় তার প্রভাব পড়বে। একটু সময়ের ব্যাপার ও আরেকটু বেশি ধৈর্যের দরকার। কিন্তু উন্নয়নের চাকা একবার চলতে শুরু করলে তার গতি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছবে।
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কখনও আদর্শিক অবস্থানে ছিল না। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক অর্জনের দোরগোড়ায় পেঁৗছেছে। গাছের যেমন শাখা-প্রশাখা বের হতে থাকে, তেমনি যোগাযোগের মূল মন্ত্র হলো রাস্তা বের করা। ঢাকা শহরে যে বনানী ফ্লাইওভার হলো, কিংবা হাতিরঝিলের রাস্তাটা যে উদ্বোধন হলো, এগুলো নতুন রাস্তা বের হওয়ার উদাহরণ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে ভ্রমণ করলে কেবল চোখে পড়ে নতুন নতুন পিচঢালা রাস্তা দূরবর্তী লোকালয় ও গ্রামের দিকে গেছে। এ ছাড়া 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ' প্রায় সব গ্রামেই বেড়েছে। ১৯৯০ সালে ঢাকার অদূরবর্তী লোকালয় বাঞ্ছারামপুর যেতে আমার একবার সময় লেগেছিল ৪ ঘণ্টা। এখন নিশ্চয়ই অত সময় লাগবে না।
সেবার খাতে বাংলাদেশ এগিয়েছে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে এবং গণসংযোগ ও বিনোদনের ক্ষেত্রে। পরিসংখ্যানে আসছে_ মৃত্যুর হার কমেছে, কমেছে শিশুমৃত্যুর হার ও শিশুর জন্মলগ্নে মাতৃমৃত্যুর হার। বার্ধক্যে পড়েছে এমন জনগোষ্ঠী বেড়ে গেছে বলে দেশব্যাপী বৃদ্ধাবাস তৈরির পরিকল্পনা অনেক ব্যবসা-উদ্যমী লোকের মাথায় এসেছে। সবচেয়ে সুখের কথা, এ বিপুল জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ পড়েছে ১৫ থেকে ৪৫ বছরের কোটায়, যার অর্থ হলো_ কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বাংলাদেশে। সে জন্য বেশকিছু বছর ধরে যে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে তার পেছনে এ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ একটি নিশ্চিত প্রতীতি বলে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট। আমার এক পশ্চিমা-প্রবাসী আত্মীয় দেশে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করাই। এ প্রবীণ জীবনের পোড়-খাওয়া লোকটি আমাকে জানালেন, ওই হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি পশ্চিমের যে কোনো উন্নত হাসপাতালের ব্যবস্থার মতোই। কোনো কোনো পরিচিতজন হৃদয়াঘাতে আক্রান্ত হয়ে দিলি্ল, ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর না ছুটে বাংলাদেশেই অস্ত্রোপচার করিয়ে শান্তিতে আছেন দেখছি। অন্যদিকে প্রায়ই শুনতে পাই, বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ওষুধের মানও নাকি ভালো।
আর গণসংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ। মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি। বাড়ন্ত শিশু থেকে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির হাতে এক বা একাধিক মোবাইল সেট। মোবাইল সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্তর্জাল ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং করপোরেট শিল্পের বিকাশের ফলে অন্তর্জালনির্ভর ব্যবসার গতি বেড়েছে। এমনকি কোরবানির পশুও অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয়েছে। আর গণমাধ্যম, মুদ্রণ এবং তড়িৎ উভয়ই ব্যাপক যেমন হয়েছে প্রচার ও বিকাশে, তেমনি গভীর হয়েছে প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বিস্তারে। একটি রাজনৈতিক সমাজ যখন এগোতে থাকে, তখন তার দুটি ধারাই সমান ক্রিয়াশীল থাকে। একটি হলো কর্মসূচি যার মাধ্যমে কর্মসম্পাদন হয়, আরেকটি হলো ওই কর্মসূচির প্রতি প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ নিউটনের সূত্রে বললে অ্যাকশন এবং রি-অ্যাকশন। এ দুটি ধারাই সমানভাবে জঙ্গম সমাজকে পুষ্টিবান করতে থাকে। টক শোর 'টক' স্বাদ বা মুদ্রিত কলামের 'তেতো' স্বাদের ব্যাপারে অনেকের মধ্যে এলার্জি লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এগুলো ওই প্রতিক্রিয়ারই অংশ। গণমাধ্যম ওই প্রতিক্রিয়া প্রকাশের অংশটা বলিষ্ঠভাবে পালন করছে। অবশ্য প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বাস্তবতা উপলব্ধির চেয়েও নৈয়ায়িক উপলব্ধির প্রাধান্য থাকে। সমাধানের কথাও বলা হয় ওই নৈয়ায়িক উপলব্ধি থেকে। কিন্তু অ্যাকশনের বাস্তবতা হচ্ছে ভেতর থেকে সৃষ্ট এবং ঘটনা পরম্পরায় তাৎক্ষণিক, কিন্তু রি-অ্যাকশনের বাস্তবতা হচ্ছে বাইরে থেকে উপলব্ধিকৃত ও পূর্বপরিকল্পিত। কিন্তু এ দুটিরই বিনুনির মতো বিকল্পজট সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ এখন সে রকম একটা পর্যায়ে পেঁৗছেছে, যখন প্রচুর অ্যাকশন দেখা যাচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে রি-অ্যাকশন। এটা আরও বেশি পরিমাণে হওয়া উচিত। কেননা সমাজ হিসেবে আমরা কৃষি-অর্থনীতি এবং শিল্প ও সেবায় খানিকটা এগিয়েছি সত্য, কিন্তু মানব জীবনের অস্তিত্বের মৌলিক প্রশ্নে, যুগপৎ আধ্যাত্মিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তায় আমাদের দর্শন বদলাচ্ছে না, সে জন্য আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে, গাড়ির সংখ্যা বা বাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু প্রগতি হচ্ছে না_ যেমন গাড়ির সংখ্যা বাড়লে, কিন্তু রাস্তা না বাড়লে তাতে যে দুর্গতি বাড়বে, কিংবা পরিবেশের চিন্তা না করে শুধু বাড়ি বানালে যে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে সে সম্পর্কে আমাদের বোধ ঘুমন্ত।
ঘুমন্ত বোধকে জাগাতে গেলে যে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার চর্চা দরকার সেটা আসতে হবে রাজনীতির পথ ধরে। রাজনীতির মৌলিক চরিত্র হলো এর মধ্যে সুর এবং অসুর পারস্পরিক সহাবস্থানে থাকে। একদিকে একনিষ্ঠতা এবং অন্যদিকে আপস, টেবিলের ওপর এক কথা, নিচে আরেক কথা_এগুলো রাজনৈতিক চরিত্রের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। এ জটিল আন্তঃকুটিলতা পরিপূর্ণ রাজনীতির মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল চিন্তাচর্চার একটিমাত্র পথ হলো, নজরুলের ভাষায়, 'থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে/কীসের নেশায় ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে'।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যুক্তিবিদ্যা এবং সাংস্কৃতিক ও নৈয়ায়িক চিন্তায় পৃথিবীর যেসব সমাজ আজকে উন্নত বলে পরিচিত, যেসব সমাজে গিয়ে ধোপা হিসেবেও জীবনযাপন করে নিঃশ্বাস নিতে পারলে আমাদের অনেকের মোক্ষ লাভ হয়, সেসব সমাজের আধুনিকায়নের ইতিহাস কিন্তু পদে পদে ধর্ম, রাজনীতি, নারী, প্রজনন এবং নিরাপত্তা ও আধিপত্যের প্রশ্নে পৌনঃপুনিক যুক্তি-প্রতিযুক্তিতে জর্জরিত হয়ে একটি অবস্থানে পেঁৗছেছে এবং সেসব প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ তাদের ক্ষেত্রে একটি জটিল আবর্তের মতো রূপ নিয়েছে, সেসব প্রশ্ন কিন্তু আমরা সতত এড়িয়ে যাচ্ছি। বর্তমানের বাংলাদেশে বিভিন্ন অঙ্গনে পরিচালনাকারী সমাজের মানুষদের মনস্তত্ত্ব যদি হাতের আঙুল দিয়ে ডাক্তারের নাড়ি টেপার মতো করে চিহ্নিত করতে হয়, তা হলে যেটা ধরা পড়বে সেটা হলো কপটতা।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, যুক্তিবিদ্যা, সাংস্কৃতিক ও নৈয়ায়িক চিন্তায় কপটতার কোনো প্রশ্রয় নেই, যদিও জীবনের অন্য অনেক ক্ষেত্রে তা আছে; কিন্তু আমরা মনে করছি কপটতা দিয়ে প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী হতে পারব। সেখানেই সংকটটা আছে এবং এ সংকট ২০১৩ সালের মধ্যে কেটে যাবে তা নয়, কিন্তু কপটতার ধার যেন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে সে আশাবাদ ব্যক্ত করে ২০১৩ সালকে স্বাগতম জানাচ্ছি।

অধ্যাপক মোহীত উল আলম : ডিন, কলা অনুষদ ও প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.