জামায়াতী তপরতায় ব্যবহৃত হচ্ছে সাবমেরিন কেবল- এমডির ভূমিকা সন্দেহজনক

 বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) অভ্যন্তরে সীমাহীন দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগের এমন একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও এ ব্যাপারে এখনও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এক প্রকার নীরবতার সুযোগে এ প্রতিষ্ঠানেরই অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে ঘাপটি মেরে থাকা উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী যাই ইচ্ছা তাই করে চলেছে বলেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়েছে, এই কোম্পানির নির্বাহী পদে ঘাপটি মেরে রয়েছেন জামায়াতী আদর্শ ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ব্যক্তি। যার পরিবারের পরিচিতিও অনুরূপ। কোম্পানির কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারসহ শেয়ারবাজারে লগ্নির মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভারি করা ছাড়াও জঙ্গীবাদে অর্থায়নেরও অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানিটির বিগত তিনটি অর্থবছরে ১৪৩ কোটি ৩৯ লাখ ৭১ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত হওয়ার পরেও এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকায় রীতিমতো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আর এত বড় অঙ্কের আর্থিক কেলেঙ্কারি উল্টো ধামাচাপা দেয়ার জন্য কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন।
চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য এবং অভিযোগ উত্থাপন করা হয় এক সেমিনারে। গত ১৪ নবেম্বর রাজধানী ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটির মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ প্রফেসর মনজুর আলম খান (তপন খান) ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে সাবমেরিন কেবল শিল্পের সঙ্কট ও সম্ভাবনা : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ’ শীর্ষক যে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তাতে এসবসহ আরও নানা তথ্য উল্লেখ করা হয়। ‘পরিরাষ্ট্রবিষয়ক কেন্দ্র’ নামের একটি সংগঠন এ সেমিনারের আয়োজন করে। সংগঠনটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ফারুক-উজ-জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি। সাবমেরিন কেবলের মতো দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানিতে উগ্র মৌলবাদী এবং জঙ্গী কানেকশনের লোকজনের ঘাপটি মেরে থাকার কথা শুনে প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে অবিলম্বে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ঘোষণা করলেও বাস্তবে গত দু’মাসেও কার্যকর কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। সেমিনারে মূল প্রবন্ধে সাবমেরিন কেবলের সীমাহীন দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রধান অতিথি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘সাবমেরিন কেবলের এই এমডি মনোয়ারকে আমি দেখব। তিনি কিভাবেইবা এতদিন এখানে অবস্থান নিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সেটা তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ মন্ত্রীর গত ১৪ নবেম্বরের এরকম ঘোষণার পরেও অদ্যাবধি কোন ব্যবস্থার কথা জানা যায়নি।
সাবমেরিন কেবলের এমডি মনোয়ার হোসেনের জামায়াত কানেকশন? ॥ বিগত বিএনপি-জামায়াত জোটের হাওয়া ভবন কানেকশনেই কপাল খুলে যায় মোঃ মনোয়ার হোসেন নামের এই ব্যক্তির। একসময় ছিলেন টেলিফোন বিভাগের কর্মকর্তা। অবসর নিয়ে চলে যান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। সেখান থেকে ফিরে সখ্য গড়ে তোলেন চাঞ্চল্যকর দশ ট্রাক অস্ত্র পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বার বার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়া সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব মোঃ ওমর ফারুকের সঙ্গে। পরবর্তীতে মনোয়ার হোসেন তাঁরই আশীর্বাদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডে (বিএসসিসিএল)। এমনকি কৌশলে নিজের মতাদর্শের পরিচয় গোপন রেখে তিনি ২০০৮ সালের দিকে এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদটিও বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। আর এই পদে আসীন হয়েই তিনি মৌলবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সাবমেরিন কেবল কোম্পানিতে। তার রয়েছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগও।
ওই সেমিনারে পঠিত লিখিত প্রবন্ধে প্রফেসর মনজুর আলম খান আরও উল্লেখ করেন যে, এমডি মোঃ মনোয়ার হোসেন’র গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায়। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর অত্যন্ত প্রতাপ ওই উপজেলায়। তার বাবা মোঃ মোশারফ হোসেন ছিলেন একজন সাধারণ শিক্ষক। স্বাধীনতাবিরোধী ওই সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের আমির ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যায় জড়িত ছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। ১৯৫২ সালে জন্ম নেয়া মনোয়ার হোসেন ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনা শেষে বুয়েটেও পড়েছেন। ছাত্র জীবনে জড়িত ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী ওই রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের সঙ্গে। চাকরি নেন রাজশাহী প্রকৌশল কলেজে। পরে চাকরি নেন টিএ্যান্ডটিতে। চাকরিকালীন স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই দলের আরেক নেতা জনৈক বশির আহমদের কন্যাকে বিয়ে করেন তিনি। প্রবন্ধে বলা হয়, বশির আহমদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির শীর্ষপর্যায়ের এক নেতার বিশেষ সখ্য ছিল। যিনি এখন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন।
সাবমেরিন কেবলে মনোয়ার হোসেনের একক কর্তৃত্ব ॥ ২০০৯ সালের বেতন কাঠামো অনুযায়ী সর্বনি¤œ ধাপ ৪১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু সাবমেরিন কেবলের এমডি মনোয়ার হোসেন একক ক্ষমতাবলে বেতন কাঠামো সর্বনি¤œ ৪০০০ টাকা থেকে ৯৫০০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়ার নিয়ম থাকলেও এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। অথচ অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট অনুযায়ী এটি একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। সরকার নির্ধারিত বেতন-ভাতার বাইরে অন্য কোন সুবিধা নিতে হলে তা অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদন নিতে হয়। একই সঙ্গে সার্ভিস রুলও মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাও মানা হয়নি। এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অডিট অধিদফতরের অডিট ইন্সপেকশনের রিপোর্ট অনুযায়ী মনে হয়, ওই প্রতিষ্ঠানে তিনি এতই স্বাধীন যে, ডাক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোন ক্ষমতা নেই তার এসব দুর্নীতির লাগাম টানতে। সরকারের এ প্রতিষ্ঠানটি ও সম্পদগুলো যেন এখন সবই মনোয়ার হোসেনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। যার কারণে তিনি সাবমেরিন কেবল কোম্পানির লভ্যাংশের টাকা সরকারী কোষাগারে জমা না করে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করে কোটি কোটি টাকা ‘কমিশন মানি’ হাতিয়ে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের অর্গানোগ্রাম তৈরিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে সংযুক্ত রাখা তো দূরের কথা তা মন্ত্রণালয়কে জানানোও হয়নি। অর্গানোগ্রাম তৈরি ও গ্রাফ আকারে প্রকাশ এবং প্রচারেও বোর্ড অব ডিরেক্টরস কিংবা টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে কিছুই জানানো হয়নি। শুধু তাই নয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অডিট অধিদফতর মনে করে, প্রতিষ্ঠানটি মূলত ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি হলেও এর সাংগঠনিক কাঠামো, সার্ভিস রুল, বুকলেট মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত নয়। একই সঙ্গে হিসাবরক্ষণ বিষয়েও কোন নীতিমালা নেই। ফলে মনোয়ার হোসেন কর্তৃক ২৪টি অনুচ্ছেদে ১৪৩ কোটি ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ২০ টাকা ব্যয় সাংঘাতিক ধরনের অনিয়ম ও ক্ষতিসাধন। এছাড়া মনোয়ার হোসেন সাবমেরি কেবল কোম্পানির আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এমনভাবে কুক্ষিগত করেছেন যাতে বাংলাদেশ সরকারের মালিকানার অস্তিত্ব একেবারেই নেই বললে চলে। এভাবেই চলছে সাবমেরিন কেবল কোম্পানি। অথচ কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এই প্রতিষ্ঠানটির মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও।
ক্যাবিনেট মন্ত্রীর চেয়েও এমডি মনোয়ার হোসেনের বেতন-ভাতা বেশি ॥ বাংলাদেশের ক্যাবিনেট মন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণে দৈনিক খরচ বরাদ্দ রয়েছে ১৩১ থেকে ২০২ মার্কিন ডলার। আর সেখানে সাবমেরিন কেবলের এমডি পাচ্ছেন দৈনিক ৫৫০ মার্কিন ডলার। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরসের কোন অনুমতি ছাড়াই বিগত ৪ বছর ধরে এ রকম লাগামহীন খরচ করছেন সাবমেরিন কেবলের বহুল আলোচিত এমডি। এমনকি তিনি মূল বেতন ৪০ হাজার টাকাসহ প্রতিমাসে ৯৫ হাজার টাকা নিচ্ছেন। বেতন-ভাতা ছাড়াও বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রীদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি সুবিধা গ্রহণ করেন তিনি। এসব ক্ষেত্রে নিজের ক্ষমতাবলে নিজের পরিবারে যত সদস্যই থাকুক না কেন সবাইকে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের খরচে ১৫ দিন পর্যন্ত বিদেশ ভ্রমণের আইন করেছেন তিনি। এছাড়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন ‘যে রকম ইচ্ছা সেরকমই।’ দেশের একটি হোটেলে এক রাতের জন্য ৫ হাজার টাকা, দৈনিক ভাতা ৩ হাজার টাকা, বিদেশে হোটেল ভাড়া বাবদ ২৫০ মার্কিন ডলার, দৈনিক ভাতা ২০০ মার্কিন ডলার এবং পরিবহন বাবদ ১০০ মার্কিন ডলার তিনি নিয়ে আসছেন। সেই সঙ্গে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়েও সাবমেরিন কেবলের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করেন যত্রতত্র। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এসব ভ্রমণের টাকার ছাড়পত্র নিতেও তাঁর কোন বেগ পেতে হয় না। এ কারণেই এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রহস্যজনক কেন তার প্রশ্ন তোলা হয়েছে প্রবন্ধে।
জঙ্গী অর্থায়ন! ॥ অভিযোগ রয়েছে সাবমেরিন কেবলের এমডি মনোয়ার হোসেন সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডকে জঙ্গী রাজনীতির অর্থায়নের স্বার্থে শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেছেন। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করে নিজেই ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৩৫টি শেয়ারের মালিক হয়েছেন। শেয়ার বিতরণে অস্বচ্ছতার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর নিজের এত বিপুল পরিমাণের শেয়ারের মালিকানা। সরকারী নিয়মানুযায়ী শেয়ারবাজার থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ সরকারী কোষাগারে জমা না করে তাঁর কাছে রেখে দেন। এক্ষেত্রে কোন ভ্যাটও তিনি পরিশোধ করেন না। কোন ক্ষেত্রেই তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন না। বিদেশী প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদারকে মালামাল প্রাপ্তির আগের মূল মূল্যের বাইরে অতিরিক্ত বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রদান করেন। কিন্তু অতিরিক্ত পরিশোধিত অর্থ আদায় করেন না। এসব অর্থ তিনি আমেরিকায় পাচার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আমেরিকায় বসবাসরত তার বড় মেয়ে ও জামাতার কাছে দুর্নীতির এসব অর্থ পাচার করা হয় বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অডিট রিপোর্টে মনোয়ার হোসেনের সকল আর্থিক অনিয়ম কিংবা অর্থ পাচারের চিত্র খাতওয়ারি উপস্থাপন করা হয়েছে। নিরীক্ষা রিপোর্টে উল্লিখিত আর্থিক কেলেঙ্কারির ১৪৩ কোটি টাকার সিংহভাগই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন ও জঙ্গীবাদের কার্যক্রমে অর্থায়ন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের অডিট এ্যান্ড এ্যাকাউন্টস অফিসার সুনির্দিষ্টভাবে ১৫টি সুপারিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু গত দুই বছরেও এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা সুনির্দিষ্ট দুর্নীতিরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উপরন্তু অডিট অফিসের কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে চিঠি দিয়ে ‘পারস্পরিক সমঝোতার’ ভিত্তিতে দুর্নীতির ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দুর্নীতির অর্থ আত্মসাতের চেষ্টায় লিপ্ত বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বপদে বহাল থাকার অপচেষ্টা ॥ গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ওই প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়। উভয় সরকারের আমলেই মন্ত্রণালয় সব কিছু তদারক করে। পরে মোঃ মনোয়ার হোসেনকে তিন বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। চুক্তির শর্ত হিসেবে গত বছরের ১ অক্টোবর তার কর্মকাল শেষ হয়। তাই ৪-৫ মাস আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। কিন্তু মন্ত্রী মনোয়ার হোসেনের রাজনৈতিক পরিচয়, দুর্নীতি, জঙ্গী কানেকশন এবং যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির বিষয়ে নেপথ্যে থেকে আর্থিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখার তথ্য জানতে পেরে তার পুনর্নিয়োগের বিষয়টি নাকচ করে দেন। এরপর মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর দফতর বদল হলে মনোয়ার হোসেন সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের বোর্ড চেয়ারম্যানকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে তাঁর চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির চিঠি দেন। মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে গিয়ে বোর্ড চেয়ারম্যানের এমন সিদ্ধান্ত এখতিয়ারবহির্ভূত। পরে এ ঘটনায় বোর্ড চেয়ারম্যান বেকায়দায় পড়তে পারেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তিনি দ্রুত তা বোর্ডসভায় অনুমোদন করিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু বোর্ড তা অনুমোদন করেনি। সরকার মনোয়ার হোসেনকে নির্দিষ্ট শর্তাদি ও বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলেও গত ৩ বছর ধরে তিনি নিয়মিত কর্মকর্তার মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এরপরও তিনি স্বপদে বহাল আছেন।
থলের বিড়াল ধরবে কে? ॥ বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের কথিত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি নিজেই নিজের বেতন-ভাতার নির্ধারক। একইসঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা প্রতিষ্ঠানের অন্য কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার করার বা বিচার-পরবর্তী আপীল করার ক্ষমতা শুধু বোর্ড অব ডিরেক্টরসের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।
শেয়ারবাজারে অনিয়ম ॥ শেয়ার ম্যানিপুলেশন বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের একটি মোটা দাগের দুর্নীতি ও অপকর্ম। এর মূলেও রয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মনোয়ার হোসেন। তিনি নিজেই ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৩৫টি শেয়ারের মালিক। এ শেয়ারগুলো যখন শেয়ারবাজারে ১০৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল তখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত আর্থিক লাভের জন্য আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড দিয়ে পূর্বের নির্ধারিত ইপিএস ৬.৩৫ কে অবমূল্যায়ন করে ৩.৩৪ নির্ধারণ করান এবং ১০৭ টাকার পরিবর্তে শেয়ার মূল্য মাত্র ৩৫ টাকা নির্ধারণ করেন। এভাবে তিনি এ খাত থেকে ৬৩০ কোটি টাকা আত্মসাত করেন, যা সরকারের ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভ করে এভাবে শেয়ার গ্রহণের কোন নজির ও সুযোগ নেই।
বোর্ড অব ডিরেক্টরস ভেঙ্গে দেয়ার দাবি ॥ সাবমেরিন কেবল কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস মূলত মনোয়ার হোসেনের পকেট কমিটি। আত্মীয়তা, রাজনৈতিক আদর্শ ও উৎকোচের কারণে ডিরেক্টররা কোন বিষয়ে কোন ভূমিকা পালন করেন না। ডিরেক্টরদের অনেকেই স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের ‘রোকন’ বা সদস্য। একজন ডিরেক্টর রয়েছেন যিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। সরকারী নিয়ম মতে, অবসরপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা এ প্রতিষ্ঠানের কোন পরিচালক হতে পারবেন না। আরেকজন পরিচালক আছেন যিনি ছাত্রজীবনে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। শিক্ষকতার কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এভাবে প্রায় প্রত্যেক পরিচালকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।
লোকমুখে নানা সন্দেহ ॥ তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে দেশে ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। খোদ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিচারকের সঙ্গে প্রবাসী বিশিষ্টজনের আলাপ নিয়ে যে ঘটনার কথা প্রচার করা হচ্ছে তা নিয়েও ইতোমধ্যে নানা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বর্তমান সরকারের শীর্ষ স্থানীয় মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত মেইল এবং ওয়েবসাইটের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়াসহ এ সংক্রান্ত বিঘœসৃষ্টিকারীরা কারও না কারও সহযোগিতা এবং যোগসাজশে এসব অপকর্ম ঘটিয়ে যাচ্ছে বলে লোকমুখে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সচেতন মহলের ধারণা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম সাবমেরিন কেবলের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা মৌলবাদী চক্রের এহেন কাজে হাত রয়েছে। আর তাইবা না হলে এ জাতীয় একের পর এক ঘটনা কিভাবেইবা ঘটে?
তদন্তের দাবি ॥ বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) অভ্যন্তরে দীর্ঘদিনের বিরাজিত দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি, জামায়াত-শিবির কানেকশন এবং জঙ্গী অর্থায়নসংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তের দাবি উঠেছে। সেই সঙ্গে গত ১৭ নবেম্বর কক্সবাজার সাগর পাড়ের কক্স টুডে নামের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গদের ব্যাপারেও খোঁজ নেয়ারও তাগিদ দেয়া হয়েছে। কেননা অভিযোগ উঠেছে যে, ওই সম্মেলনে সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিপুলসংখ্যক জামায়াতী ঘরানার লোকজনই অংশগ্রহণ করেছিলেন। এসব লোকজনকে সরকারী খরচে কেন এবং কী উদ্দেশ্যে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?

No comments

Powered by Blogger.