টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে বাকৃবিতে বেপরোয়া ছাত্রলীগ

 বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বেপরোয়া হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি ও শতাধিক পদে কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারসহ পূর্ব শত্রুতার জের ও নিয়োগ বাণিজ্যে প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই মূলত শনিবারের সংঘর্ষে নিহত হয় আট বছরের শিশু রাব্বি।
চলতি সপ্তাহে এ নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। এই নিয়োগকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব লাভে স্বপ্নে বিভোর ও ক্ষমতালোভী মিডলেভেলের একটি পক্ষ আজাদ-ইমন নেতৃত্বের বিভেদকে প্রকাশ্যরূপ দিতে পুরো ঘটনাকে উস্কে দেয়। আর এরকম পরিস্থিতিকে ক্যাম্পাসে নিজেদের শক্তির জানান দিতে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়ার এক পর্যায়ে গুলিবিনিময়ে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগের দু’গ্রুপ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাঠে গরু চড়াতে এসে দুগ্রুপের সশস্র মহড়ার বলি হয়ে লাশ হয় স্থানীয় বয়রা গ্রামের অটো রিকশা চালক দুলালের শিশুপুত্র রাব্বি।
অসহায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও এসব নিয়ে এখন ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। অভিযোগ রয়েছে মাথাভারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে সুবিধাবাদী বিএনপি ও জামায়াতপন্থীদের কলকাঠিতে চলছে সবকিছু। শনিবারের সংঘর্ষের নেপথ্যেও ছিল টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা বিএনপি ও জামায়াতপন্থী একটি সিন্ডিকেটের প্রভাব বিস্তার।
গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. একেএম জাকির হোসেন শনিবারের ঘটনাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে জানান, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব জুনিয়রদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এই ঘটনাটি ঘটেছে। তবে এবারের এই ঘটনার পেছনে নিয়োগ বাণিজ্য কিংবা টেন্ডারের কোন বিষয় ছিল না বলে দাবি করেন এই শিক্ষক নেতা। তিনি আরও জানান, সরকার ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তদন্ত-পূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানান তিনি। সোনালি দলের সাবেক সভাপতি প্রফেসর নজরুল ইসলাম এ নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব শীঘ্রই শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে এমনটি আশা করছেন এই শিক্ষক নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নেতাসহ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা শনিবারের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে একাধিক শিক্ষক নেতা জানান, টাকা কামানোর নেশাসহ কোন ঘটনার বিচার না হওয়ায় ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। তিনি জানান, ছাত্রলীগ নিজেদের আধিপত্য দেখাতে গিয়েই মূলত শনিবারের ঘটনা ঘটিয়েছে। এটি কারও কাম্য নয়। আগামী সিন্ডিকেটের সভায় বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরা হবে বলে তিনি জানান। শনিবারের ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. রফিকুল হক জনকণ্ঠকে জানান, এটি ছাত্রলীগের নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। ছাত্রনেতাদের লেজুড়বৃত্তির কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অফিসার ও কর্মকর্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম্মি কর্তৃপক্ষ অনেক সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে না।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত বছরের অক্টোবরে শিক্ষকদের সহায়তায় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নেতা কর্মীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ফ্রন্ট নেতাকর্মীরা বর্ধিত ফী প্রত্যাহারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে মিছিলসহ প্রশাসনিক ভবনের দিকে আসার পথে পুলিশের উপস্থিতিতে এই হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগ। নানা প্রতিবাদ ও আন্দোলনসহ এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও বহাল তবিয়তে থাকে ছাত্রলীগ। এছাড়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও ফাও খাওয়া নিয়ে রাতারাতি বেপরোয়া হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ। গত বছর ক্যাম্পাসের কামাল রণজিত মার্কেটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী হারেছের দোকান থেকে চা সিগারেট নিয়ে টাকা না দেয়ার প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় হারেছের পুত্র রতন। ভাংচুর করা হয় হারেছের চা দোকানটি। এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগের হাতে নাজেহাল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় ছাত্র রণি ও কিরণ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রণি ও কিরণকে বহিষ্কার করেছে এবং একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস পুড়ানোর ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলাতেও স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে আসামি করা হয়েছে রণি ও কিরণকে। স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বীনা) উপকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিটি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি আব্দুস সালাম গোপালগঞ্জের উপকেন্দ্র নির্মাণের টেন্ডারে অংশ নিতে এসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন গত বছরের ১৩ মে। অভিযোগ ছাত্রলীগের সঙ্গে নেগোসিয়েশনসহ নগদ কমিশন না দেয়ায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। বীনার ঘটনায় আব্দুস সালাম বাদী হয়ে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে ছাত্রলীগের সভাপতি আজাদ, সাধারণ সম্পাদক ইমনসহ ছাত্রলীগ নেতাদের নামে মামলা করেছিলেন কোতোয়ালি থানায়। কিন্তু এই মামলায় কিছুই হয়নি ছাত্রলীগ নেতাদের।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আব্দুস সাত্তার ম-লের মেয়াদে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ না দেয়ায় ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শাহীন আলমকে প্রধান প্রকৌশলীর সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় জোটবদ্ধ হয়ে প্রকৌশলীরা নালিশ করেছিলেন ভিসির কাছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগে চলছে ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য। এখানের সব টেন্ডারের কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগ। বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রধান প্রকৌশলীর দফতর থেকে ৩-৪ কোটি টাকার টেন্ডার হয়ে থাকে। ঠিকাদারদের ৫০ হাজার টাকা থেকে ৫০-৬০ লাখ টাকার প্রতিটি টেন্ডারে ছাত্রলীগকে ১০ শতাংশ হারে বাধ্যতামূলক কমিশন দিতে হয় বলে জানা গেছে। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন টেন্ডারে এখন আর যোগ্য কোন ঠিকাদার অংশ নেয় না। ফলে প্রতিযোগিতা ছাড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব টেন্ডারের কাজ। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রকৌশলী জানান, এর আগেও ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে টেন্ডারবাজি করেছে। তবে এত ব্যাপক ও বেপরোয়া ছিল না। ছাত্রলীগ নেতাদের নামে থানায় মামলা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করার পরও কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না বলেই দিন দিন এভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এর ময়মনসিংহের সদর দফতরে নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনায় সংস্থাটির মহাপরিচালক ছাত্রলীগের হামলায় লাঞ্ছিত হন। অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ নিয়ে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ড. আক্তার হোসেন, প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার ম-লসহ বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. রফিকুল হকের মেয়াদে শিক্ষক, অফিসার ও কর্মকর্তা নিয়োগেও ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

No comments

Powered by Blogger.