রাজধানীতে এ বছরই শেষ হচ্ছে নির্মাণ কাজ- চার সরকারী স্কুল কলেজ

জমি উদ্ধার সংক্রান্ত জটিলতাসহ নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ঢাকার ১৭ সরকারী হাইস্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার আলোচিত প্রকল্পের কাজ।
চলতি বছরেই চার থেকে পাঁচটি স্কুল ও কলেজের পুরো নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হচ্ছে। আগামী বছর জানুয়ারি থেকেই সেখানে শুরু হতে পারবে শিক্ষা কার্যক্রম। বাকি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কাজও সিংহভাগ ২০১৪ সালেই শেষ হচ্ছে। তবে নানা বাধাবিপত্তির কারণে নির্ধারত সময় অর্থাৎ ২০১৪ সালেই প্রকল্পের পুরো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি গোষ্ঠীর রিট মামলা থাকায় সবুজবাগে সরকারী মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি) এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার গাফিলতির জন্য ৪-৫টির কাজেও বিলম্ব হচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশাল এই জনগোষ্ঠীর মানসম্মত শিক্ষাপ্রাপ্তির বহু যুগের আকাক্সক্ষা পূরণে সরকারের এই উদ্যোগ যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে।
গত এক সপ্তাহ সরকারের নির্ধারিত স্থান সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্রই পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে মোট ৪১টি থানায় ২৪টি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ১১টি সরকারী কলেজ রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরের প্রায় অর্ধেক থানায় কোন সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা কলেজ নেই। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মহানগরীতেও জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও নতুন কোন সরকারী স্কুল-কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই কাজে হাত দেয়। সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ঢাকা মহানগরীতে ১১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ছয়টি মহাবিদ্যালয় (সরকারী) স্থাপন প্রকল্পটি গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে একটি করে ছয়তলা ফাউন্ডেশনে চারতলা একাডেমিক ভবন থাকবে। ভবনটিতে অধ্যক্ষ/ প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, উপাধ্যক্ষ/সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, অফিস কক্ষ, কমনরুম এবং শিক্ষক মিলনায়তন থাকবে। প্রতিটি ভবনে ১০টি শ্রেণীকক্ষ থাকবে। প্রতিটি কক্ষের শিক্ষার্থী ধারণ ক্ষমতা ৫০। প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (ডাবল শিফটসহ) ৫২ জন শিক্ষক ও সাত জন কর্মচারী এবং প্রতিটি সরকারী মহাবিদ্যালয়ে ৪৭ জন শিক্ষক ও ২২ জন কর্মচারী নিয়োজিত থাকবেন। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৫০০ জন। তবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ডাবল শিফটে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হবে। নির্মাণ কাজ সমাপ্তির পর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, বই-পুস্তক, অফিস যন্ত্রপাতি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য ডিজিটাল বোর্ড ও বিনোদনের জন্য খেলাধুলার সামগ্রী সরবরাহ করা হবে। এ ছাড়া প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে। কম-বেশি এক একর জমির ওপর এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের স্থান চিহ্নিত করে প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে দু’একটি স্থানে জমি নিয়ে জটিলতায় পড়ে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। আলেচিত এ প্রকল্পের নাম ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইলেভেন সেকেন্ডারি স্কুল এ্যান্ড মিক্স কলেজেস (গবর্নমেন্ট) ইন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটি।’ কাজের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাজারীবাগে নতুন ‘শেখ রাসেল সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১১ সালের ১১ জুলাই এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয় ওই বছরের ১৮ অক্টোবর। সম্প্রতি শেখ রাসেল বিদ্যালয়ের ৪র্থ তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বিদ্যালয় নির্মাণের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে।
হাজারীবাগে একই স্থানে ‘বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারী মহাবিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১১ সালের ২৫ জুলাই এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয় ওই বছরের ১৮ অক্টোবর। ওই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের কাজের ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। মিরপুর পল্লবীতে ‘দুয়ারীপাড়া সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলছে। ওই প্রতিষ্ঠানের নতুন ভবনের তৃতীয় তলার ছাদ ঢালাই হয়েছে গত নবেম্বরে। ওই বিদ্যালয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ২৫ শতাংশ কাজ হওয়ার পরও মামলার কারণে একই স্থানে ‘দুয়ারীপাড়া সরকারী মহাবিদ্যালয়’ স্থাপনের কার্যক্রম বন্ধ আছে। দুয়ারীপাড়া সরকারী মহাবিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত জমির মালিকানা দাবি করে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি মামলা করায় সেখানে মহাবিদ্যালয় নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। মোহাম্মদপুর সরকারী কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটসংলগ্ন সরকারী জমিতে সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজে বিলম্ব হয়েছে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের বিরোধিতার কারণে। তবে সম্প্রতি আলোচনার মাধ্যমে ওই সমস্যার সমাধান হয়েছে এবং বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা গেছে। কাফরুলে ‘ভাষানটেক সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ এবং ‘ভাষানটেক মহাবিদ্যালয় নির্মাণের কাজ চলছে। সম্প্রতি ওই স্কুলের ভবন নির্মাণের জন্য পাইলকাস্টিং হয়েছে। একই স্থানে ভাষানটেক সরকারী মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজও এগিয়ে চলেছে। মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাইলকাস্টিং সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে কাজের প্রায় ২০ শতাংশ শেষ হয়েছে। উত্তরায় দক্ষিণখান সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফাউন্ডেশন ও শর্ট কলাম ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। একই স্থানে দক্ষিণখান সরকারী মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজও এগিয়ে চলছে। মহাবিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের পাইলকাস্টিং চলছে। এ ছাড়া ডেমরায় হাজী এমএ গফুর সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এগুচ্ছে ধীরগতিতে।
বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজ বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা করছে একটি গোষ্ঠী। মিরপুরে দারুসসালাম সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভবন নির্মাণের সয়েল টেস্ট (মাটি পরীক্ষা) শেষ হয়েছে। ৩ ডিসেম্বর স্থাপনা নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়। আর উত্তরায় উত্তরাখান সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থাপনা নির্মাণের জন্য ৩ ডিসেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু দুটি প্রতিষ্ঠানেরই নির্মাণ কাজ শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছে। ইইডির গাফিলতির জন্য শ্যামপুরে জুরাইন সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্থাপনা নির্মাণ কাজ পিছিয়ে পড়ছে। ওই স্থানে বিদ্যালয় নির্মাণের জন্য জমি রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) কাজ শেষ হয়েছে। এরপর ২২ নবেম্বর জমি ইইডিকে বুঝিয়ে দেয়া হলেও কাজ এগুচ্ছে না। এখনও সেখানে সয়েল টেস্টই শুরু করেনি ইইডি। বড় মগবাজার সরকারী বিদ্যালয়ের নির্মাণের কাজও ঢিমেতালে এগুচ্ছে। মগবাজারে জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসন মূল্য নির্ধারণের কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যান সরকারী মহাবিদ্যালয় স্থাপনের কাজও এগুচ্ছে ঢিমেতালে। ওই স্থানে ভবন নির্মাণের জন্য সয়েল টেস্টের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনও জমি বন্দোবস্ত বা দান কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে। আর কামরাঙ্গীরচর সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জমির রেজিস্ট্রশন কার্যক্রম এরই মধ্যে সম্পন্ন হলেও নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারছে না ইইডি। কারণ ওই জমি এখনও অবৈধ দখলদারদের ভোগদখলে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে রিট মামলা থাকায় সবুজবাগ সরকারী মহাবিদ্যালয় স্থাপনের দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। এদিকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ভূমিদস্যুদের নজর আছে যুগান্তকারী এই প্রকল্পের জন্য নির্ধারণ করা জমির দিকে। তাই কাজ করতে গিয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের নানামুখী বাধার মধ্যে পড়তে হয়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কাজের অবস্থা ভাল হলেও অসাধুচক্রের বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন এলাকাবাসী। এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই বলছেন, সরকারী জমি হলেও এর প্রতিটি স্থানই দখল করে মার্কেট কিংবা অন্য কিছু বসিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা করেছেন প্রভাবশালীরা। তাই তারা দখল ছাড়তে চায় না। ফলে সরকারের পরিকল্পনা যতই মহৎ হোক জমি ছাড়তে নারাজ অবৈধ দখলদার ও ভূমিদদ্যুরা। কাজের সর্বশেষ পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মানিক চন্দ্র দে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এ প্রকল্পেকে যুগান্তকারী উদ্যোগ অভিহিত করে তিনি বলেন, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ কার্যক্রম চলমান আছে। চলতি বছরেই অন্তত চার থেকে পাঁচটি স্কুল ও কলেজের পুরো নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হবে বলে আমরা আশাবাদী। আগামী বছর জানুয়ারি থেকেই যেখানে শুরু হতে পারবে শিক্ষা কার্যক্রম। বাকি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কাজও এগোচ্ছে ভালভাবেই।

No comments

Powered by Blogger.