রিমান্ডে মোশাররফঃ আমি সামনে, পেছনে মন্ত্রী by আদিত্য আরাফাত

পদ্মাসেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় মহাজোট সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বাদ পড়লেও দুদকের তদন্তে ঘুরেফিরে আসছে তাদের নাম।
বৃহস্পতিবার সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও প্রকৌশলী কাজী মোঃ ফেরদৌসকে সাতদিনের রিমান্ডের প্রথম দিনের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে যে, কানাডিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পেতে আবুল হোসেনের `ইশারা` ছিল। দুদকের তদন্ত টিম আরো জানতে পেরেছে, লাভালিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানই আবুল হোসেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। দুজনের জবানবন্দির এমন তথ্য পেয়ে এগিয়ে চলছে দুদকের তদন্তের কাজ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

বৃহস্পতিবার পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান দুই আসামি মোশাররফ ও ফেরদৌসকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ডে (হেফাজতে) পাঠান আদালত। এর আগে বুধবার হাইকোর্ট চত্বরের বাইরে থেকে তাদের গ্রেফতার করে দুদক।

বৃহস্পতিবার সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সাতদিনের রিমান্ডে প্রথম দিনের রিমান্ড শুরু হয় বেলা ২টায়। শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টায়। দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে।

দুদক সূত্র জানায়, পাঁচ ঘণ্টার রিমান্ডে দুই আসামিকে দুদক কার্যালয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও জেরা করা হয়। এ সময় পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের পেছনে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়।

কেন চারবার টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি ভাঙা হয়েছে—দুদকের এমন প্রশ্নবানে মোশাররফ বলেছেন, “টেন্ডার কমিটি পরিবর্তন সংক্রান্ত সেতু কর্তৃপক্ষের যে নথি রয়েছে, তাতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর স্বাক্ষর আছে। সেসব নথির অনুলিপি মন্ত্রীর সরকারি পিএসের মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছে। কমিটি ভাঙাগড়ার দায় শুধু আমার ওপর বর্তায় না।”

সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের তদন্ত টিমকে সাবেক এ সচিব বলেন, “আপনারা তদন্ত করে দেখুন।”

এসএনসি লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী কমিটি ভাঙতে নির্দেশ দিয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে মোশাররফ আবার বলেন, “আপনারা তদন্ত করে দেখুন।”

এক পর্যায়ে দুদকের প্রশ্নবানে সেতু বিভাগের সাবেক এ সচিব বলেন, “আমাকে সামনে রেখে পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজ করানো হয়েছে। আমি ছিলাম সামনে, মিনিস্টার পেছনে।”

তদন্ত সূত্র জানায়, লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আবুল হাসানের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে লাভালিন কর্মকর্তদের পরিচয় করিয়ে দেন আবুল হাসানই।

এদিকে, কাজী ফেরদৌসকে প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যেতে চান। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, সরকারি কর্মকর্তা হয়ে দেশের এত বড় প্রকল্পের জন্য পরামর্শক সংস্থা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ঘটনা জানার পরও তিনি কেন টেন্ডার কমিটি থেকে সরে দাঁড়াননি বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানাননি। কাজী ফেরদৌস এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বলে জানা গেছে।

মামলা দায়েরের ৯ দিন পর গত বুধবার হাইকোর্ট চত্বরের বাইরে থেকে মোশাররফ ও ফেরদৌসকে গ্রেফতার করে দুদক। গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদক পরিচালক উইং কমান্ডার তাহিদুল ইসলাম। গ্রেফতার শেষে সেদিনই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ দুই আসামিকে ধানমণ্ডি থানা হেফাজতে রাখা হয়।
আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পদ্মাসেতু প্রকল্পে কানাডিয়ান কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক হিসেবে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফসহ সাতজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয় গত ১৭ ডিসেম্বর। সাত আসামির মধ্যে বাংলাদেশের চারজন ও বিদেশি তিনজন।

পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে গত ২৯ জুন।

পরে সরকার অভিযোগ অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করার পর ‘শর্তসাপেক্ষে’ বিশ্বব্যাংক আবার অর্থায়নে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। গত ৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যালেন গোল্ডস্টাইন বলেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলেই কেবল এ প্রকল্পে অর্থ মিলবে। মামলার পর ১৮ ডিসেম্বর আরেক বিবৃতিতে অ্যালেন জানিয়েছেন, এজাহার পর্যবেক্ষণের পর বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদনের ওপর অর্থায়ন নির্ভর করবে।

No comments

Powered by Blogger.