জাদুকর এবং তার ‘পরানের গহীন ভেতর’ by ফারুক আহমেদ

 বারো বছর বয়সে প্রথম লিখলেনÑ ‘আমার জানালার পাশে একটি গাছ রহিয়াছে/তাহার উপর দুটি লাল পাখি বসিয়াছে।’ অনুভূতি এই যে প্রকাশ হতে শুরু করল, তা জীবনভর অব্যাহত।
হাত দিয়েছেন সাহিত্যের প্রায় সব মাধ্যমে এবং দেখিয়েছেন শিল্পীর নৈপুণ্য। বিশেষত কথাসাহিত্যে তাঁর লেখা পাঠ করামাত্র টের পাওয়া যায় এ লেখা সৈয়দ হকের। এ লেখার ভাষা স্বকীয়।
এত কিছুর পরও উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্যনাট্য, গদ্য (‘হৃৎকলমের টানে’ এবং ‘মার্জিনে মন্তব্যে’র মতো রচনা), গীত এবং চিত্রনাট্য, অনুবাদÑএতকিছুর পরও তিনি বহুবার বলেছেনÑকবিতাই। কবিতার প্রতিই তাঁর বিশেষ পক্ষপাতিত্ব। এই পক্ষপাতের পক্ষে অবশ্য যথেষ্ট প্রমাণও আছে। নানা সময়ে সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে এই যে কাজ করাÑ কখনও উপন্যাস, কখনও অনুবাদ। এর ভেতরেও কাব্যসাধনা সব সময় সরব ছিল। এই সরবতা এখনও, একজন তরুণ যে উত্তেজনায় লিখে যান অনবরত, তেমনি তিনি লিখে যাচ্ছেন। তারুণ্য, এই তারুণ্যই এক ধরনের বিরোধাভাস বলে মনে হয়। একজন তরুণের কলম দিয়ে বেরিয়ে আসে একের পর এক রচনা। কিন্তু পূর্ণতা, পরিমিতি তা কিন্তু তারুণ্যে থাকে না। তার জন্য প্রয়োজন হয় সময়ের, প্রস্তুতির এবং অনবরত নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। যাহোক, লিখে যাওয়ার এই যে তাড়না, তা বিবেচনা করলে সৈয়দ শামসুল হক ৭৮-এ এসেও (গতকাল ৭৮-এ পড়লেন) তরুণই। আর না হয় এত মাধ্যমে কাজ করার পরও কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২৫-এর অধিক এবং কবিতার সংখ্যা দেড় হাজারের বেশি হয় কি করে। তাঁর এই বিশাল কবিতাভুবনে প্রবেশ করামাত্র এর বিচিত্রগামিতাও টের পাওয়া যায়। বিষয় এবং প্রকরণগত দুই ক্ষেত্রেই লিখেছেন নানা ধরনের কবিতা। এই বিপুল কাব্যাধার থেকে এখানে একটি বিশেষ কবিতা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস থাকল। বিশেষ এই অর্থে যে, কবিতা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা, তার অবয়ব দীর্ঘ। সাহিত্যে দীর্ঘ কবিতা নামে একটি বিশেষ ধারাও রয়েছে।
অ্যাডগার অ্যালান পো তার ‘কবিতার মূলসূত্র’ প্রবন্ধে লিখেছেন কবিতা দীর্ঘ হলে আর কবিতা থাকে না। অ্যালান পোর মতো একজন শক্তিমান কবির মন্তব্য অবশ্যই আমলে নিতে হবে। তবে কবিতায় সর্বসিদ্ধ বলে তো কোন ব্যাপার নেই। ভাংচুর এবং নতুন রূপÑ যুগ যুগ ধরে কবিতা এমনই। একজন শক্তিমান কবির আবির্ভাব মানে কবিতার ভাংচুর যেন অবধারিত। এবং তাতে আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করি এক নতুন স্বাদের কবিতা আস্বাদনের জন্য। অ্যালান পোর এই মন্তব্য মাথায় থাকল, তা মাথায় রেখেই প্রবেশ করা যাক সৈয়দ শামসুল হকের দীর্ঘ কবিতা ‘পরানের গহীন ভিতর’-এ। প্রবেশ করামাত্রই চোখ পড়ে- ‘জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,’ পঙ্ক্তিটি। কারণ এটাই কবিতার সূচনা লাইন। এটা পড়েই ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দূর থেকে আসা একটা নিবিড় মুগ্ধতা ঘিরে ধরতে থাকে একটু একটু করে। তারপর সেই বিখ্যাত দু’টি লাইনÑ এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর॥।
‘পরানের গহীন ভিতর’ একটি দীর্ঘ কবিতা। যা ৩২ ভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটি ভাগে রয়েছে ১৪ পঙ্ক্তি। প্রতিটি পঙ্ক্তি ১৮ মাত্রার। এসব বিবেচনায় এ কবিতা প্রকৃতপক্ষে ৩২টি সনেটের একটি সংঘ, যে সংঘের নাম ‘পরানের গহীন ভেতর’। বহু বহু আঞ্চলিক শব্দের যুতসই ব্যবহার শেষ পর্যন্ত কবিতাটিকে একটি বিশেষ মাত্রা দিয়েছে; যা শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক ভাষায় লেখা এক অনবদ্য কবিতা বলে বিবেচনা করা যায়। অনবদ্য এই কারণে, তা আমাদের ভেতর যে ব্যঞ্জনার জন্ম দেয়Ñ তা বহু সময় ধরে ডালপালা ছড়াতে থাকে। অনেকক্ষণ দলে আমরা শব্দ থেকে শব্দের ভেতর ঘুরে বেড়াই, তাদের নানা ভঙ্গিমায় আক্রান্ত হয়ে। তবে পুরোটাই একটা কবিতা এবং একটা সুরই বাহিত হয়েছে পুরো কবিতাটিতে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে ৩২টি সনেট। ৩২টি সনেট মানে ৩২টি আলাদা সত্তাই হওয়ার দাবি রাখে। কেননা ত্রয়োদশ শতকে ইতালিতে জন্ম নেয়া এই সনেট নামক কবিতার মূলমন্ত্রই হলো জমাটবন্ধতা। ১৪টি লাইনে ছোট্ট এক কুটির কবি তার সকল ঐশ্বর্য দিয়ে নির্মাণ করবেন। যা নির্মাণের পর এতটুকু উপকরণও বাকি থাকবে না, কোন আফসোসও অবশিষ্ট থাকবে না যে...। এক্ষেত্রে এই ভাব প্রলম্বিত হওয়া মানে সনেটের মূলের ব্যত্যয়। এখানে কয়েকটি উদারহণ দেয়া যাক। বাংলা সাহিত্যে মাইকেলই প্রথম সনেট লিখেনÑ আমরা তা সবাই জানি। এবং তিনিই বোধহয় সবচেয়ে সফলও। তারপর অনেকেই চেষ্টা করেছেন। কেউ সফল হয়েছেন, কেউ ব্যর্থ এবং ওই ব্যর্থর তালিকা খুব ছোট নয়। আশ্চর্য হলেও সত্যি, সেই ব্যর্থদের তালিকায় আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সনেট সম্পর্কে মোহিতলাল মজুমদারের মন্তব্য হলোÑ ‘বরীন্দ্রনাথ কতক উৎকৃষ্ট চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করিয়াছেনÑখাঁটি সনেট একটিও রচনা করেন নাই।’
এখানে উল্লেখ্য, মাইকেল যেসব সনেট লিখেছেন, তার প্রতিটি পঙক্তি ছিল চৌদ্দ মাত্রার। পরবর্তী সময়ে তা ভেঙে ১৮, ২২, ২৪ বা তার অধিক মাত্রায় লেখা পঙক্তিও দেখা যায়। বিশেষত ‘জীবনানন্দ দাশের তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো লিখেছেন ২২ মাত্রার। মাত্রার এই সম্প্রসারণ তিনি ঘটালেও অন্তমিলের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন অসাধারণ নৈপুণ্য। মূল পেত্রার্কীয় সনেটের মতো অন্তমিলের ক্ষেত্রে প্রতিটি কবিতায় দেখা যায় তিনিÑকখখককখখক/গঘগঘঙঙ-এর বিন্যাস ঘটিয়েছেন। অনুপ্রাসের ক্ষেত্রে এতটুকু শিথিলতা নেই। তবে অবশ্যই অনেক কবি সনেটের এই ফর্মকে ভেঙে নিজের মতো করতে চেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে এই প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়। জীবনানন্দ দাশের ২২ মাত্রায় বা এর থেকেও বেশি মাত্রায় রচিত সনেট দেখে অবশ্য কবি আবদুল কাদির শঙ্কা বোধ করেন। তিনি লিখেন, ছন্দোমুক্তির নামে ছন্দোশীলনে এরূপ অনিয়ম-প্রিয়তার নিদর্শন সমকালীন কবিতায় প্রচুর দেখা যায়। তাতে অক্ষরবৃত্তের দৃঢ়নিবদ্ধ বলিষ্ঠ সুঢৌল রূপ হচ্ছে শ্লথসজ্জা ও নৈরাজ্যমুখী।
‘পরানের গহীন ভেতর’-এর প্রথম যে সনেটটি তার অন্তমিল এ রকমÑ কখকখগঘগঘঙচঙচছছ। তবে দ্বিতীয় সনেটে এসে দেখা যায় কবি মিলের ক্ষেত্রে নিরীক্ষা চালিয়েছেন, এর অন্তমিলÑ কখখকগঘঘগঙচচঙছছ। এ রকম নিরীক্ষা আরও বেশ কটিতে দেখা যায়। এখানে অষ্টক এবং ষষ্টক আলাদাভাবে না থাকায় অন্তমিলের ক্ষেত্রে আলাদা করে দেখানো হয়নি। জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’য় কী নিপুণভাবেই না অন্তমিল যোজন করেছেন। এর আগে মোহিতলাল মজুমদার বা প্রমথ চৌধুরীসহ অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা সনেট লিখেছেন সিদ্ধহস্তে। সেক্ষেত্রে এ সময়ের একজন প্রভাববিস্তারকারী রচয়িতার কবিতায় এ রকম মিল কি তার ভিন্ন নিরীক্ষার ফল। অবশ্য মিলের এই নিরীক্ষার ব্যাপারটা আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’-এও দেখা যায়। তার থেকেও বড় কথাÑ একটি অনুভূতি, একটি ভাবনার বিস্তার একাধিক সনেটে যদি ঘটে, তাহলে কি তার ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপার থাকে না? ছড়িয়ে পড়া মানে তো আর সনেট থাকল না। অক্ষরবৃত্তের যে দৃঢ়নিবদ্ধ বলিষ্ঠতা তা থাকল না। একজন পাঠক হিসেবে আমার ভেতর এসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। কবিতার প্রকরণগত বিষয় নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, যদিও এসব তাঁদের গবেষণার বিষয়।
আমাদের এ সময়ের কবিতা শব্দালঙ্কার থেকে অর্থালঙ্কারের দিকে বেঁকে গেছে। ফলে প্রকরণগত এসব বিষয় আমাদের খুব একটা ভাবায় না। যেহেতু সনেট নামক একটি ফর্মÑ যা কবিদের কাছে সব সময় সবিশেষ বিবেচিত। তাই এর ভেতরটা একটু দেখে নেয়ার চেষ্টা। ‘পরানের গহীন ভেতর’ কবিতাটি আমাদের কাব্যসাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। এক্ষেত্রে আমাদের কবিতায় সবিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে যায় যেসব রচনা, তার অভিন্নতর পাঠ সাধারণত হয় না। তাই এখানে প্রকরণগত দিক থেকে একটু আলোচনার অবকাশ।
‘পরানের গহীন ভেতর’ এমন একটি কবিতা, যা পাঠ শুরু করামাত্র আমাদের আন্দোলিত করতে শুরু করে। কবিতায় প্রবেশ করে দেখা যায়Ñ বুকের ভিতর শিস দিয়া সন্ধ্যা হাঁটে আশেপাশে। বা শব্দের ভিতর থিকা মনে হয় শুনি কার স্বর,/একজন, দুইজন, দশজন, হাজার হাজারÑ। এ রকম অগণিত পঙ্ক্তি আমাদের মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর করে রাখে। আমরা অগণিত, নানান রঙের উপমার ভেতর ডুবে যাই, চিত্রকল্পের ভেতর ডুবে যাই, তারপর ভেসে উঠি। আবারও ডুবে যেতে থাকি। এভাবে আমাদের পরানের ভেতর বহু বহু শব্দ তোলপাড় তোলে। ভাবনা জাগ্রত করে রাখে।

No comments

Powered by Blogger.