প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম- ইংরেজী নববর্ষ ভাবনা

 ইংরেজী পঞ্জিকা আমাদের দেশে চালু হয় পলাশীর যুদ্ধে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে জেঁকে বসে তাদের দেশে কিন্তু এই পঞ্জিকা চালু হয় ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে। আমরা যাকে ইংরেজী সন বলি আসলে এটা গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার।
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পাপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী প্রাচীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কার সাধন করে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের উদ্ভব ঘটান। তিনি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫ অক্টোবরকে ১৫ অক্টোবর ধরে নতুন নিয়মে সন গণনার সূত্রপাত ঘটান। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখ লেখার শেষে যে এডি (অ.উ.) লেখা হয় তা এ্যানো ডোমিনি (অহহড় উড়সরহর)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই এ্যানো ডোমিনির অর্থ আমাদের প্রভুর বছরে (ওহ ঃযব ুবধৎ ড়ভ ড়ঁৎ ষড়ৎফ) অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ। ডাইওনীসিয়ান একমিগুয়াস নামক এক খ্রিস্টান পাদরী জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫৩২ অব্দে যিশুখ্রিস্টের জন্ম বছর থেকে হিসেব করে এই এ.ডি. বা খ্রিস্টাব্দ লিখন রীতি চালু করেন। ইংরেজী ক্যালেন্ডারে যে মাসগুলো আছে তার অধিকাংশই গ্রীকদের দেব-দেবীর নাম ধারণ করে আছে। এই ক্যালেন্ডারের জুলাই মাস সম্রাট জুলিয়াস-সিজারের নাম ধারন করে আছে এবং আগস্ট নাম ধারণ করে আছে সম্রাট অগাস্টাসের নাম। অথচ আমাদের দেশে প্রচলিত হিজরী সনের মাসগুলো কিন্তু কোন দেব-দেবীর নাম ধারণ করেনি, বাংলা সনের মাসগুলোও কোন দেব-দেবীর নামে পরিচিত হয়নি। ইংরেজী সন একটি সৌরসন, বাংলা সনও সৌরসন কিন্তু হিজরী সন চান্দ্র সন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আমি (আল্লাহ) রাত্রি ও দিবসকে করেছি দু’টো নিদর্শন, রাতের নিদর্শনকে করেছি অপসারিত এবং দিনের নিদর্শনকে করেছি আলোকপ্রদ যাতে তোমরা তোমাদের রব-এর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং যাতে তোমরা বর্ষসংখ্যা ও হিসাব জানতে পারো। (সূরা বনী ইসরাইল : আয়াত ১২)।
নববর্ষ এবং বর্ষগণনা সংস্কৃতির বিশেষ উপাদান। একটি জাতির সংস্কৃতি সেই জাতির নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, ধান-ধারণা ইত্যাদি সামগ্রিক পরিচয় স্পষ্টভাবে ধরে রাখে এবং তা বিশ্ব দরবারে সেই জাতির আত্মপরিচয়কে বুলন্দ করে দেয়। মূলত সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির আয়না। সংস্কৃতির বহুবিধ উপাদানের মধ্যে নববর্ষও অন্যতম। আমরা যাকে ইংরেজী সন বা খ্রিস্টাব্দ বলি, আসলে এটা হচ্ছে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার। বাংলা ভাষায় অব্দ শব্দের চেয়ে সন ও সাল দুটি বেশি পরিচিত ও সর্বাধিক প্রচলিত। সন শব্দটি আরবি এবং সাল শব্দটি ফারসী। সন ও সাল এই শব্দ দুটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত, আমাদের তমুদ্দীনীয় উৎস সঞ্জাত।
আমাদের দেশে বর্তমানে তিনটি সন প্রচলিত আর তা হচ্ছে হিজরী সন, বাংলা সন ও ইংরেজী সন, এখানে হিজরী সনের প্রচলন হয় যেদিন এখানে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে তখন থেকেই। এই হিজরী সন মুসলিম মননে পবিত্র সন হিসেবে গৃহীত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মুনওয়ারায় হিজরত করেন। ইসলামের ইতিহাসের সেই দিগন্ত উন্মোচনকারী ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে এই হিজরী সন। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর খিলাফতকালে তাঁরই উদ্যোগে হিজরতের বছর থেকে হিসাব করে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হয়। সেটা ছিল হিজরতের ১৭ বছর। যতদূর জানা যায়, তারই পরের বছর থেকে বাংলাদেশে সাংগঠনিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়Ñআর তখন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতের মধ্য ভাগ। অবশ্য প্রায় ১০/১২ বছর আগ থেকেই বাংলাদেশে সমুদ্রপথে ইসলামের খবর এসে পৌঁছতে থাকে। ইসলামের আগমনের সাথে সাথে বাংলাদেশে হিজরী সনেরও আগমন ঘটে কারণ এই সনের বিভিন্ন মাসে ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান, এবাদত-বন্দেগীর নির্দিষ্ট দিন-রজনী, তারিখ ও নির্দিষ্ট মাস প্রভৃতি রয়েছে। এই হিজরী সনই বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সবচেয়ে পুরনো সন।
১২০১ খ্রিস্টাব্দে সিপাহসালার ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখ্তিয়ার খিল্্জী বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের বিজয় নিশান উড্ডীন করেনÑ আর তখন থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরী সন বাংলাদেশে প্রচলিত হয়, যা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সুলতানী আমলে কি মুঘল আমলে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে, আদান-প্রদান তথা সর্বক্ষেত্রে হিজরী সনই প্রচলিত ছিল। অবশ্য মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ঋতুর সাথে সম্পৃক্ত একটি সৌর সনের তাকীদ রাজস্ব বা ফসলী সনের প্রবর্তন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, হিজরী সন চান্দ্র সন হওয়ায় ঋতুর সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকে না।
সম্রাট আকবরের নির্দেশে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী, সম্রাট আকবরের মসনদে অধিষ্ঠিত দেওয়ার বছর ৯৬৩ হিজরী মুতাবিক ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের নির্দিষ্ট তারিখ থেকে হিসাব করে হিজরী সনকে সৌর গণনায় এনে যে সনটি উদ্ভাবন করেন সেটাই আমাদের দেশে বাংলা সন নামে পরিচিত হয়। হিজরী সনের বছরের হিসাব ঠিক রেখেই এর মাসগুলো নেয়া হয় শকান্দ থেকে। বৈশাখ মাসকে স্থির করা হয় বছরের প্রথম মাস।
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই সম্রাট আকবরের ফরমান বলে রাজত্বের রাজস্ব আদায়ে সন হিসেবে তা প্রচলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশে হিজরী সনের সৌরকরণ পঞ্জিকাটি ব্যাপকভাবে গৃহীত ও সমাদৃত হয় যা, একান্তভাবে বাংলার মানুষের নিজস্ব সন হিসেবে স্থান করে নিতে সমর্থ হয়। আর এখানে ইংরেজী সন এলো সেই ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পরাধীনতার শেকল পরিয়ে। একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে কিন্তু এখন পর্যন্ত ইংরেজী সনের গ্রহণযোগ্যতা তেমন একটা নেই। আবার শহর জীবনে বাংলা সনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। অবশ্য শহুরে জীবন কি গ্রামীণ জীবনে হিজরী সনের প্রচলন সমানভাবে বর্তমান। বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও সংহতির অন্যতম অবলম্বন এই হিজরী সন। আর এই হিজরী সন থেকে উৎসারিত বাংলা সন আমাদের জাতীয় জীবনে নিজস্বতার বৈভব এনে দিয়েছে।
মুসলিম দুনিয়ার অনেক দেশেই হিজরী সনের চান্দ্র হিসারের বৈশিষ্ট্যেই জাতীয় সন হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। এমনকি এই সনের সৌর হিসাব এনে বাংলা সনের মতোই কোন কোন দেশে প্রচলিত রয়েছে। যেমন ইরান হিজরী সনকে সৌর হিসাবে এনে সেখানে হিজরী সন প্রচলিত রয়েছে। ইরানে নওরোজ পালিত হয় হিজরী সনের শামসী বা সৌরকরণের হিসাবে আনা তাদের নিজস্ব মাসের ১ম তারিখে। আমাদের দেশে হিজরী সনের সৌর হিসাবের প্রথম মাস বৈশাখ মাস, তেমনি ওখানে হচ্ছে ফারবারদীন প্রথম মাস। এই মাসের ১ তারিখ ওদের হয় ২১ মার্চ। আর আমাদের ১ বৈশাখ হয় ১৪ এপ্রিল। আমাদের দেশে বাংলা যে আনন্দ বৈভব কি গ্রামে কি নগরে-গঞ্জে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, ইংরেজী নববর্ষ কিন্তু শহুরে জীবনের মুষ্টিমেয় বিশেষ মহলে ছাড়া তা ব্যাপকভাবে কোথাও আলোড়ন সৃষ্টি করে না। তবুও ইংরেজী নববর্ষ আসে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার ঘণ্টা বাজার পর পরই ঘোষিত হয় এই তিন ঐতিহ্যজাত নববর্ষের সূচনা মুহূর্তে ঘোষিত হয় ইংরেজী নববর্ষের আগমন বারতা। মধ্যরাতের সেই মুহূর্তটা আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে কোনরূপ আনন্দ-আবেগ সৃষ্টি না করলেও খ্রিস্টান জগৎ ওই মুহূর্তে হ্যাপি নিউ ইয়ার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এক হৈ-হুল্লোড়ে উল্লাস ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ঘটে যায় কতই না অঘটন, ঘটে যায় কতই না পৈশাচিক কর্মকা-, মদ্যপানের নামে বহু স্থানে জীবন পানের মহড়াও চলে। ইংরেজী নববর্ষ আসে রাতের গভীরে নিকষ অন্ধকারে প্রচ- শীতের প্রবাহ মেখে।
ইংরেজী ক্যালেন্ডার যেহেতু আমাদের কাজকর্মের তারিখ নির্ধারণে, হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণে, আন্তর্জাতিক আদান-প্রদানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাই এতে যতই ঔপনিবেশিক গন্ধ থাকুক না কেন, যতই এতে প্রায় ২০০ বছরের গোলামির জোয়ালের চিহ্ন থাকুক না কেন, আমরা এর থেকে মুক্ত হতে পারছি না এই কারণেই বোধ করি যে, আমরা স্বকীয়তা সজাগ হওয়ার চেতনার কথা বললেও, আমরা নিজস্ব সংস্কৃতিকে অনুন্নত করার কথা বললেও তা যেন অবস্থার দৃষ্টিতে মনে হয় বাতকা কি বাত তথা কথার কথা, ইংরেজী নববর্ষ আমাদের স্কন্ধে সিন্দবাদের সেই দৈত্যটির মতো, সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে চেপে বসে আছে যে, আমরা একে ছাড়তে পারছি না!

লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.