তাজমহল ও ফতেহপুর সিক্রি দেখার অভিজ্ঞতা ॥ by হাবিবুর রহমান স্বপন

 প্রেম বিশুদ্ধতার অনুপম প্রতীক তাজমহলের নিচে গ্রাউন্ডফ্লোরে মমতাজ এবং শাহজাহানের কবর। দোতলায় ডামি বা ফলস্ কবর। নিচের তলায় বা গ্রাউন্ডফ্লোরে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার নেই।
তবে বিশ্বের কোন বিশেষ বা সম্মানীয় ব্যক্তির জন্য নিচে কবর দেখার ব্যবস্থা করা হয়। মমতাজের কবরের ডানে শাহজাহানের কবরটি আকারে খানিকটা বড়। মমতাজের কবরের ওপর প্যাসেজে আরবী ক্যালিওগ্রাফিতে লেখা আছে ‘আল্লাহপাকের ৯৯ নাম এবং আরবীতে যা লেখা আছে তার অর্থ ‘এখানে ফেরেশতাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত আল্লাহর এক ভক্ত শায়িত আছেন।’ শাহজাহানের কবরের উপরের প্যাসেজে আরবী ক্যালিওগ্রাফিতে লেখা আছে ‘আল্লাহর এই বান্দা দুনিয়া ভ্রমণ শেষে মৃত্যু বরণ করেন রজব মাসের ২৬ তম রজনীতে ১০৭৬ হিজরীতে’। তাজমহলের দেয়ালে পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াত সুরা ইয়াসিন, সুরা আনসহ যে ১৪ টি আয়াত লেখা আছে তা সাদা মার্বেল পাথরের ওপর লেখা; যা ‘জ্যাসপার ইনলাইং’ দ্বারা করা।
তাজমহল হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মিনারের নির্মাণশৈলী এবং স্থাপত্য অতুলনীয়। ৪২ একর জমি রয়েছে তাজমহলের আঙিনায়। এর মধ্যে রয়েছে মসজিদ, বিশ্রামাগার, বাগান, পানির ফোয়ারা এবং খোলা সবুজ ঘাসের চত্বর। যমুনা নদীর (এটা বাংলাদেশের যমুনা নদীর মতো বড় বা প্রশস্ত নয়; আমাদের দেশের ছোট নদীর মতো, যা শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যায়) তীর ঘেঁষে ৫০ ফুট উঁচু বেদির ওপর নির্মিত। চার কোণায় চারটি মিনার রয়েছে। গোলাকৃতির গম্বুজ। এর ব্যাস ৫৮ ফুট এবং উচ্চতা ৮১ ফুট। এই গম্বুজও স্ফটিক বা মার্বেল পাথরের তৈরি।
তাজমহলের ভেতর ও বাইরের দেয়াল সাদা ধবধবে মার্বেল পাথরে তৈরি । প্রতিটি পাথর আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুট বর্গাকৃতির। পাথরের পুরুত্ব প্রায় এক ইঞ্চি। এত বড় পাথর কিভাবে সমান মাপে কেটে মসৃণ করা হয়েছে এবং তা দেয়ালে লাগানো হয়েছে! এখনও এ নিয়ে নির্মাণবিদরা অবাক হন। তখন তো এখনকার মতো যান্ত্রিক সুবিধা ছিল না।
তাজমহলের মার্বেল পাথর এবং মূল্যবান নানা প্রকার পাথর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। ভারতের রাজস্থান ও পাঞ্জাব এবং তিব্বত, চীন, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আরব থেকে এসব পাথর সংগ্রহ করা হয়। তাজমহলে ব্যবহৃত হয় ২৮ প্রকার মূল্যবান পাথর। এসব পাথর দিয়ে তাজমহলের দেয়ালে লতা-পাতা-ফুলের মনোরম নক্সা করা হয়েছে। যার অনেকটাই ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ গবর্নর উইলিয়াম বেন্টিক-এর সময় ও ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সময় এবং ১৯৪৭ সালে ভারত- পাকিস্তান বিভক্তির সময় চুরি গেছে। বহু মূল্যবান পাথর হীরা, নীলা, চুনি পাথর দেয়াল থেকে তুলে নিয়ে গেছে ব্রিটিশ সৈন্য ও চোররা। এখন তাজমহলের নিরাপত্তা যতটা মজবুত আগে তেমনটি ছিল না। আমি ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তাজমহল পরদর্শন করার সময়ও তেমন নিরাপত্তার কড়াকড়ি দেখিনি। কিন্তু ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে যখন স্ত্রী এবং পুত্রকে নিয়ে গিয়েছিলাম তখন দেখেছি কঠোর নিরাপত্তা। এখন নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ভারতের এলিট ফোর্স ‘ব্লাক ক্যাট’। ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক প্লাটুন সৈন্য।
মোবাইল ফোনের টর্চ লাইট যদি আপনি তাজমহলের দেয়ালে ধরেন দেখবেন সাদা মার্বেল পাথর জ্বলজ্বল করছে। আমি ছোট্ট একটি পেনসিল টর্চ লাইট নিয়ে তাজ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দেয়ালে ধরলাম দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। আরও বিস্মিত হলাম যখন টর্চের আলো ফেললাম দেয়ালের লতা-পাতা-ফুলের ওপর। এ দৃশ্য বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। যেন জীবন্ত ফুল এবং লতাপাতা ! দেয়ালে কারুকাজ করা মহামূল্যবান জহরত, হীরা এবং নীলা পাথর চুরি হয়ে গেছে। সেসব স্থানে এখনও খতের চিহ্ন বিদ্যমান।
তাজমহলের দৃশ্য একেক সময় একেক রকম হয়। সূর্যোদয়ের সময় হলুদ রং ক্রমশ তা হাল্কা গোলাপি আভা ধারণ করে। দুপুরে, বিকালে, সূর্যাস্তের সময় এবং জ্যোৎ¯œা বা চাঁদনী রাতে রং-এর পরিবর্তন হয়। হাসি-কান্নার এক রহস্যময়তা তাজমহলের শরীর জুড়ে দেখা যায়। কেউ কেউ এই রূপ পরিবর্তনকে নারীর সৌন্দর্য বা নারীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রূপ পরিবর্তনের তুলনা করেছেন। এক ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী তাজমহলকে নিখুঁত মুক্তার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এক ফরাসী সাহিত্যিক তাজমহল সম্পর্কে বলেছেন ‘এটি একটি নিখুঁত বাড়ি, যা সম্রাটের প্রেমগর্বিত আবেগ এবং জীবিত পাথরের নীড়।’ এক চীনা পরিব্রাজক বলেছেন, তাজমহল তৈরি করে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখেছে।
তাজমহল থেকে মাত্র ২০ মিটার পশ্চিমে মসজিদ এবং সমান দূরত্বে পূর্বদিকে নওকাবখানা। মসজিদে সাড়ে পাঁচ শ’ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। শুক্রবার এলাকার মুসল্লীরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন। এ কারণে শুক্রবার দর্শনার্থীর জন্য বন্ধ থাকে। এই মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ কাজ দেখতে উপস্থিত হতেন প্রতিদিনই। তার বসার জন্য এবং দর্শনার্থীদের জন্য নওকাবখানা নির্মাণ করা হয়।
তাজমহলের অভ্যন্তরে তরল খাবার জাতীয় কোন কিছু নিতে দেবে না নিরাপত্তা কর্মীরা। সন্দেহ হলেই ব্লাক ক্যাট সদস্যরা জিজ্ঞাসা করেন তবে খুবই বিনয়ের সঙ্গে। উপরের ফ্লোরে ওঠার সময় সাবধানে উঠতে হবে। মার্বেল পাথরের ওপর যদি বৃষ্টির পানি পড়ে তা হয় পিচ্ছিল। যেহেতু আপনাকে খালি পায়ে বা পাদুকা ছাড়া (মোজা পড়া যাবে) তাজমহল পরিদর্শন করতে হবে। অতএব সাবধান!
যেহেতু আমার পূর্বপুরুষরাও ট্যাক্স দিয়েছেন ভারতের তৎকালীন সম্রাট শাহজাহানকে তাই আমিও সপরিবারে আমার বন্ধুর যুক্তি মোতাবেক ভারতীয় সেজে মাত্র ২০ টাকার টিকেট করে তাজমহল দেখেছি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে। আমি এবং আমার স্ত্রী টিকেট কাটলাম দুটো। ছোট ছেলে রাতুলের বয়স যেহেতু ৬ বছর, তাই ওর টিকেট লাগল না (এখন অবশ্য অর্ধেক লাগে)। ১ নং গেট দিয়ে তাজমহলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। মূল ফটকে এবং ভেতরের পরবর্তী প্রবেশ পথে দু’দফা মেটাল ডিটেক্টর দ্বারা পরীক্ষা করা হলো। তাজমহলের সিঁড়িতে ওঠার সময় হঠাৎ করেই একজন সাদা পোশাকের ব্লাক ক্যাট অফিসার আমাকে ডাকলেন এবং খুবই বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেনÑআর ইউ বাংলাদেশী? আমি আগে থেকেই এ রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম। উত্তরে বললাম ‘নো আই অ্যাম ই-িয়ান।’ এবার প্রশ্ন ‘হোয়াট ইজ ইয়োর এ্যাড্র্সে?’ আমি ঝটপট উত্তর দিলাম ‘থ্রি বাই সেভেন, সল্টলেক, ক্যালকাটা।’ এবার আবার প্রশ্ন হিন্দিতে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গলকা মূখ্যমন্ত্রীকা নাম কিয়া হ্যায় ?’ উত্তর দিলাম ‘বুদ্ধদেব ভট্টাচারিয়া।’ এবার আবার প্রশ্ন ‘ইন্ডিয়ান ফরেন মিনিস্টারকা নাম কিয়া হ্যায়?’ আমার উত্তর ‘যশবন্ত সিনহা।’ রক্ষা পেলাম। সাদা পোশাকের ওই ব্লাক ক্যাট আমার পিছু ছাড়ল। ভয়ে ভয়ে তাজমহল দেখে ফিরলাম। হোটেলে ফিরে আমার স্ত্রী আমাকে বলল, আচ্ছা তুমি তো ঝটপট উত্তর দিলে। ওরা যদি আমাকে অথবা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করত তা হলে কি হতো ? নির্ঘাত ধরা পড়তে হতো এবং জরিমানা গুনতে হতো মাথাপিছু দুই হাজার টাকা। সর্Ÿোপরি বিষয়টি হতো লজ্জাকর। তখন বোধোদয় হলো তাই তো! কাজটি করা তো মোটেই ঠিক হয়নি। তবে আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি পূর্বপূরুষের দেয়া ট্যাক্সের টাকা ‘উসুল’ করতে পেরে মজাই পেয়েছিলাম ! আমাদের সফরসঙ্গী মকিবুল, শফি, শহীদ, রমজান ও জাহিদ ভারতীয় হিসাবে ২০ টাকার টিকেট কেটেছিলেন। কিন্তু গেটে জিজ্ঞাসাবাদে ফেরত এসেছিলেন। আগ্রা যেয়েও তাদের তাজমহল দেখা হয়নি।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.