‘স্বপ্ন আর প্রত্যয় নিয়ে সামনে চলো’by আসিফ ত্বাসীন

 কনকনে শীত। বহমান শীতল হাওয়া। কাজ না থাকলে এমন দিনে ঘর থেকে বের না হয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকাটাই আনন্দের। কিন্তু বৃহস্পতিবার দিনটি একটু অন্যরকম।
এদিন বের না হলেই বরং আনন্দ মাটি! একটু পরই প্রকাশিত হবে পরীক্ষার ফল। উৎকণ্ঠা আবেগ আর অনিশ্চয়তার দোলাচলে বেরিয়ে পড়ে দেশের ক্ষুদে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। গন্তব্য তাদের স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
কেবল রোদ উঁকি দিয়েছে, এমনই এক ক্ষণে প্রকাশিত হলো দেশের সবচেয়ে বড় দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফল। এ ফল পেয়ে ঘরে বসে থাকলে হবে কি করে! আনন্দটুকু শেয়ার করতে হবে না! দেশের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিল সবচেয়ে বড় বড় পরীক্ষায়। প্রাথমিক সমাপনী আর জেএসসি-জেডিসি। সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন তারা। আলো ঝলমলে হয়ে উঠল তাদের নিষ্পাপ মুখগুলো। তাদের সাফল্য কেবল নিজেদেরই গর্বিত করল না, গর্বিত করল তাদের পরিবারপরিজন আর শিক্ষকদের। তাদের সম্মিলিত সাফল্য মিলে হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গর্ব।
সকাল থেকেই উৎকণ্ঠা আর বুক চিনচিনে ভাব। ‘হবে তো আশাজনক রেজাল্ট? উজ্জ্বল করতে পারব বাবা-মার মুখখানি?’ শেষমেশ সাফল্যের হাতছানি আর বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। এই শীতের দিনে ঘেমে নেয়ে একাকার। স্কুলের মাঠগুলো হয়ে উঠল শিক্ষার্থীদের আনন্দের প্রধান কেন্দ্র। সেখানেই নেচে গেয়ে মেতে উঠল সবাই। আনন্দের বহির্প্রকাশ তারা কিভাবে করবে তা যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। বন্ধুদের জড়িয়ে ধরা, নাচগান, ড্রাম বাজানো আর মাঠের এ প্রান্ত ও প্রান্ত দৌঁড়ে বেড়ানো। আর তাদের সঙ্গে আসা অভিভাবকরাও যেন তাল দিচ্ছিলেন সন্তানদের। তারাও কাজ ফেলে শিশুর আনন্দের অংশীদার।
ঐন্দ্রিলা। ভিকারুন নিসা থেকে প্রাথমিক সমাপনীতে অংশ নিয়েছিল। জিপিএ ৫ পাওয়ায় সে কী করবে, কী করবে ভাবতে ভাবতে ছুটোছুটি করছিল। খুশিতে বাগবাকুম! এক মুহূর্ত স্বস্তি পাচ্ছিল না। কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘কেমন যেন লাগছে! আনন্দে কী করব বুঝতে পারছি না। আম্মুকে খুঁজছি, আমার সঙ্গেই এসেছিল। কোথায় যে গেল?’ বলেই দে ছুট। তার পিছু নিয়ে দেখা গেল মায়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। বুকে জড়িয়ে আছেন তার স্নেহের সন্তানকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভাল রেজাল্টের জন্য মেয়ে অনেক কষ্ট করেছে। সেজন্য তার প্রাপ্তিটাও এত আনন্দের।
জেএসসিতে ভাল ফল করা মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের আমিনুল ইসলাম পড়াশোনার পাশাপাশি দুষ্টুমিতেও কম যায় না। বন্ধুদের গালে ভরিয়ে দিচ্ছিল রঙবেরঙের জরি। আর বারংবার চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করছিল। স্কুলের ইউনিফর্ম পরে এসেছিল কিন্তু তার অবস্থার দিকে কোন নজর নেই। তার প্রাপ্তি কি আশার চাইতেও বেশি? না। সে বলল, জানতাম ভাল করব, তারপরও কেন এত খুশি লাগছে বুঝতে পারছি না।
আনন্দের আতিশয্যে উদ্বেলিত প্রাথমিক সমাপনীতে জিপিএ ৫ পাওয়া শামসুজ্জামান ভূঁইয়া নিশাদ বলছিল, তার খুব ভাল লাগছে এরকম ভাল রেজাল্ট করতে পেরে। সে বড় হয়ে ভাল ক্রিকেটার হতে চায়, কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে আরও ভাল করতে চায়।
নুসরাত তাহ্মিনা মিশু রেজাল্ট পেয়েই বাবার মোবাইল ফোন থেকে পরিচিতদের কল করা শুরু করল। ‘জিপিএ ফাইভ পেয়েছি, দোয়া করবেন...’ আনন্দে মুক্তো ঝরছিল যেন তার চোখেমুখে। এত অল্প বয়সে এত বড় তৃপ্তি আর সাফল্য অর্জনের সৌভাগ্য হলো দুটি পরীক্ষায় পাস করা দেশের প্রায় ৪৩ লাখ শিক্ষার্থীর।
সকাল থেকেই রাজধানীর স্কুল প্রাঙ্গণগুলো ভরে উঠেছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের পদচারণায়। উৎসুক মুখে অপেক্ষায় ছিলেন রেজাল্টের। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যেও বয়ে গেল আনন্দের ঝলকা হাওয়া। আশপাশের মিষ্টির দোকানগুলোতে ভিড় জমিয়ে ফেললেন সঙ্গে সঙ্গে। পরে যদি পাওয়া না যায়!
শিক্ষার্থীদের এ সাফল্য শুধু তাদের নিজেদেরই সাফল্য নয়, এর জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও যথেষ্ঠ অবদান রয়েছে বলে জানালেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ। তাঁদের সঙ্গে একমত শিক্ষার্থীরাও। তারাও নিজেদের সাফল্যের ভাগ দিল তাদের অভিভাবক আর শিক্ষকদের।
গত বছরের মতো এ বছরও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় দেশ সেরা হয়েছে রাজধানীর মনিপুর স্কুল। সেখানকার শিক্ষার্থী-অভিভাবক আর শিক্ষকদের মাঝে বিরাজ করছিল অন্যরকম আনন্দ। মনিপুর স্কুলের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন বলেন, শিক্ষক ও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকার কারণেই এ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
জেএসসি পরীক্ষার ফলে প্রথম স্থান অধিকার করেছে রাজউক মডেল স্কুল। তাঁর স্কুলের এ ফল অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে জানিয়েছেন অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমামুল হুদা। তিনি বলেন, টানা দ্বিতীয় বারের মতো জেএসসির ফলে রাজউক তার অবস্থান ধরে রাখতে পারায় আমরা খুবই খুশি। শিক্ষকদের আন্তরিকতা আর অভিভাবকদের ঐকান্তিক চেষ্টায় এ ফল অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
এ বছর ফলে বেশ ভাল একটা চমক দেখিয়েছে ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তারা সারাদেশে প্রাথমিক সমাপনীর ফলে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এ প্রসঙ্গে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের স্কুলের সাফল্যের পেছনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এ তিনের সমন্বিত প্রয়াস ছিল। এ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বেশ মেধাবী ছিল। তাদের সবার চেষ্টা আর আল্লাহর রহমতে এত ভাল ফল।

No comments

Powered by Blogger.