চলে গেলেন সঙ্গীতগুরু সোহরাব হোসেন- আজ শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা

হৃদয় দিয়ে গান ভালবেসেছিলেন সোহরাব হোসেন। গানকেই মেনে ছিলেন জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। সুরের কাছে সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে। শিল্পী হওয়ার ক্রমাগত সাধনার পাশাপাশি নিজের সবটুকু মেধা ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর মাঝে।
এভাবেই সঙ্গীতের সঙ্গে গড়েছিলেন আত্মার বন্ধন। আর ৯১ বছরে গানের সঙ্গে এই বন্ধন ছিন্ন করে ইহলোক থেকে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন সঙ্গীতগুরু, নজরুলগীতির বরেণ্য শিক্ষক ও শিল্পী সোহরাব হোসেন। বৃহস্পতিবার থেমে যায় তাঁর সাধনাময় জীবনের পথচলা। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিভে গেল দেশের নজরুলসঙ্গীতের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের দীপশিখা। ভোর ছয়টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিলাহি ... রাজিউন)। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, ডায়াবেটিস ও ঠা-াজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। রেখে গেছেন স্ত্রী সুরাতুন্নেচ্ছা, তিন মেয়ে রওশন আরা সোমা, রাহাত আরা গীতি ও রিফাত আরা রিতা এবং দুই ছেলে মোয়াজ্জেম হোসেন ও মারুফ হোসেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার সোহরাব হোসেনের মরদেহ রাখা হবে স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে। আজ শুক্রবার সেখান থেকে সকাল ৭টায় মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের বাসায় নেয়া হবে শিল্পীর শবদেহ। সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য সকাল ১০টায় নেয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বেলা ১২টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে বাদ জুমা ইকবাল রোডের বাসার পার্শ্ববর্তী মসজিদে জানাজা হবে। জানাজা শেষে তাঁকে মিরপুর শহীদ বৃদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে। এছাড়া শহীদ মিনার থেকে ছায়ানট ও নজরুল ইনস্টিটিউটে নেয়া হতে পারে। তবে বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি।
সোহরাব হোসেনের মেজ জামাতা আহসান হাবীব বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, ডায়াবেটিস, ঠা-াজনিত রোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। শুক্রবার ভোরে তাঁর একটি হার্ট এ্যাটাক হয়। এরপর ৬টা ২৫ মিনিটে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি নেফোলজি বিভাগের ডা. আব্দুল ওহাব খানের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে চিকিসাধীন ছিলেন। তিনি আরও বলেন, গত নবেম্বরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে সময় তাঁর খাওয়ায় অরুচিসহ বিভিন্ন ঠা-াজনিত সমস্যা ছিল। পরে গত ১৩ ডিসেম্বর তাঁকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ১৬ ডিসেম্বর পুনরায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় তাঁর হৃদযন্ত্রেও সমস্যা দেখা দেয়। একইসঙ্গে বুকে প্রচুর পরিমাণে কফ জমে।
সোহরাব হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সোহরাব হোসেনের মৃত্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের ক্ষতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে শোক জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার মোঃ আবদুল হামিদ ও ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। এছাড়া ছায়ানট, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে।
সকালে সোহরাব হোসেনের মৃত্যুর সংবাদে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে আসেন সঙ্গীতজ্ঞ ও দীর্ঘদিনের বন্ধু সুধীন দাস, ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, কণ্ঠশিল্পী শাহীন সামাদ, খায়রুল আনাম শাকিল, ডালিয়া নওশীন, সাদিয়া আফরিন মল্লিক, রফিকুল আলমসহ সঙ্গীতাঙ্গনের সংশ্লিষ্টরা।
বন্ধুর প্রস্থানে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সুধীন দাস। বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন, ১৯৪৮ সালে রেডিওতে গান করার সময় থেকে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। এরপর বিরতিহীনভাবে ৬৪ বছরের বন্ধুত্বের পথচলা। আমাদের বন্ধুত্ব কেমন ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। আজ ও আমাকে একা রেখে চলে গেল। আমি অসহায় হয়ে গেলাম। তাঁর মতো এত প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছ্বল বন্ধু পাওয়া দুষ্কর। এমন বন্ধু আর কখনও পাওয়া যাবে না। জীবন চলার পথে আমরা সবাই কোন না কোনভাবে দুঃখ পাই। কিন্তু সোহরাবের মাঝে কখনও কোন দুঃখবোধ দেখিনি। এটাই ছিল তাঁর বিশেষত্ব। আর তাঁর মৃত্যুতে একটা অধ্যায়ের অবসান হলো। নজরুলসঙ্গীতে এমন সুরেলা কণ্ঠ আর আসবে কি না সন্দেহ।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, ‘শিল্পীর সঙ্গে একজন মানুষ হিসেবেও সোহরাব হোসেন ছিলেন অসাধারণ। তিনি মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। এ দেশে নজরুল চর্চার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট অবদান রেখেছেন। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি সহযোগিতা করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানের নজরুলসঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর শিক্ষার্থীরা আজ দেশের বড় বড় শিল্পী। আজকে নতুন প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে তেমন একটা জানে না। তাদের মাঝে তাঁর কাজকে ছড়িয়ে দিতে হবে।’
ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন বলেন, সোহরাব ভাইকে ছাড়া এখনও কিছু ভাবতে পারি না। তিনি আমাদের বড় আশ্রয় ছিলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তাঁর কাছে তিন বছর গান শিখেছি। আমি ছিলাম তাঁর গানের গুণমুগ্ধ শ্রোতা। অসাধারণ ছিল তাঁর গায়কী। টানা তিন বছর তাঁর কাছে গান শিখেছি। নজরুলের ইসলামিক গান, আধুনিক ও পল্লীগীতি শিখেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। তাঁর মতো করে নজরুলসঙ্গীত কেউ গাইতে পারবে না। তাঁর গায়কী আঙ্গিক আমি রপ্ত করেছি। তাঁর ভা-ারে যা ছিল তিনি আমাকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। আমার আজকের সন্্জীদা খাতুন হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। সোহরাব হোসেনের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথা তুলে ধরে সন্জীদা বলেন, একসময় শাহীন (শিল্পী শাহীন সামাদ) তাঁর কাছে গান শিখতে এসে খুব আপনজন হয়ে যায়। কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধার পাশাপাশি এতটাই পছন্দ করতাম যে, এ বিষয়টি নিয়ে আমার খুব হিংসা হতো। কারণ, আমার পরে পরিচয় হয়েও শাহীন তাঁর আপনজন হয়ে গিয়েছিল। আমি তাঁকে খুব ভালবাসতাম। তিনিও আমাকে অনেক ভালবাসা দিয়েছেন। একপর্যায়ে আক্ষেপ করে বলেন, শেষ বয়সে নতুন কিছু দিতে না পারলেও, তাঁর থাকাটাই ছিল বড় ভরসা।
টেলিফোনে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় প্রখ্যাত নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম বলেন, অনেক সুকণ্ঠের গায়ক ছিলেন সোহরাব হোসেন। নজরুলের গান নিয়ে একনিষ্ঠভাবে কাজ করার অন্যতম কৃতিত্বের দাবিদারও তিনি। পঞ্চাশের দশকের আগে তিনি কিন্তু অন্য ধারার গানে ছিলেন। এরপর নিয়মিতভাবে নজরুলের গান নিয়ে কাজ করে গেছেন। তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রীও নজরুলসঙ্গীতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটা একজন শিল্পী হিসেবে সোহরাব হোসেনের অনেক বড় সার্থকতা। আর গানের শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন সফল ছিলেন, ঠিক মজার একজন মানুষ হিসেবেও সবাই তাঁকে জানত। যেখানেই যেতেন পুরো পরিবেশকে উৎসবমুখর করে রাখতেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী শাহীন সামাদ বলেন, ছায়ানটে সোহরাব হোসেনের কাছে আমি গান শিখেছি। তাঁর হাতেই আমার সঙ্গীত শিক্ষা। গানের শিক্ষক হিসেবে তিনি যা দিয়েছেন, তা কখনও ভুলব না। তিনি চলে গেলেও হাজার হাজার শিল্পী রেখে গেছেন। জীবনের সবটুকু ভালবাসা তাঁর জন্য। বাকি জীবন তাঁকে স্মরণ করে বাঁচব। আর ছায়ানটের শিক্ষার্থীদের মাঝে তাঁর শিক্ষা ছড়িয়ে দেব।’
সোহরাব হোসেনের জন্ম ১৯২২ সালের ৯ এপ্রিল জন্ম নেন। জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাট শহরের কাছে আয়েশতলা গ্রামে। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। নয় বছর বয়সে রানাঘাটের এক আসরে প্রথমবারের মতো শোনেন নজরুলের গান। এরপরেই নজরুলের গানের প্রেমে পড়েন। এ সময় জয়নুল আবেদীন নামে এক শিক্ষকের কাছে প্রথম তালিম নেন। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় জমিদার ক্ষীরোদ পাল চৌধুরীর নজরে পড়েন তিনি। তিনি তাঁকে কিরণ দে চৌধুরীর নামে এক সঙ্গীতগুরুর কাছে তালিম নিতে পাঠান। এছাড়া তিনি প্রখ্যাত নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পূরবী দত্তের বাড়িতে তাঁর দাদার গানের শিক্ষার আসরে গান শুনতে যেতেন। তবে তাঁর সঙ্গীতপ্রীতি ভাল চোখে দেখেনি তাঁর পরিবার। তাঁর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে তাঁকে পারিবারিক ব্যবসার কাজে নিয়োজিত করেন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি সঙ্গীতচর্চা। রানাঘাটে একবার শিল্পী আব্বাস উদ্দীন, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, পল্লীকবি জসীমউদ্্দীন এবং তবলা বাদক বজলুল করিমের সঙ্গে একই মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সোহরাব হোসেন। একসময় শিক্ষক কিরণ দে চৌধুরীর মাধ্যমে পরে কলকাতায় গিয়ে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে মাসে ১২ আনা বেতনে গান গাওয়ার কাজ পান। পরে ১৯৪৬ সালে আব্বাস উদ্দীনের মাধ্যমে একটি পাবলিসিটি বিভাগে চাকরি পান। এ সময়ই তিনি এইচএমভি ও রেডিওতে অডিশনে পাস করেন। কলকাতায় তিনি আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, গিরীশ চক্রবর্তী, কৃষ্ণচন্দ্র দের মতো বিশিষ্ট শিল্পীদের সাহচর্যে আসেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন সোহরাব হোসেন। আব্বাস উদ্দীনের মাধ্যমে ৪১ জিন্দাবাজার লেনের একটি বাড়িতে ওঠেন। চাকরি পান তথ্য বিভাগে। এছাড়া তিনি নিয়মিত রেডিওতে অনুষ্ঠান এবং টিউশনিও করতেন। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, শিল্পী শচীন দেব বর্মণ এবং অঞ্জলি মুখার্জীর সঙ্গেও ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। তিনি আব্বাস উদ্দীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নানা স্থানে ঘুরেছেন এবং গান গেয়ে বেড়িয়েছেন।
সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও সোহরাব হোসেন একইসঙ্গে জনপ্রিয় ও মেধাবী। বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ছায়ানট, শিল্পকলা একাডেমী ও নজরুল একাডেমীতে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ শিক্ষকতা করেছেন নজরুল ইনস্টিটিউটে। তাঁর কাছে শেখা শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেনÑ সঙ্গীতজ্ঞ ড. সন্জীদা খাতুন, শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, আতিকুল ইসলাম, শাহীন সামাদ, সাদিয়া আফরিন মল্লিক ও মাহমুদুর রহমান বেনু।
নজরুলসঙ্গীতের পাশাপাশি আধুনিক গানেও পারদর্শী ছিলেন সোহরাব হোসেন। চলচ্চিত্রেও প্লেব্যাক করেছেন সোহরাব হোসেন। তার প্লেব্যাক করা চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছেÑ মাটির পাহাড়, যে নদী মরুপথে, গোধূলির প্রেম, শীত বিকেল ও এদেশ তোমার আমার। আর তিনি শুধু সঙ্গীতেই নয়, অভিনয়েও পারদর্শী ছিলেন। কার্জন হল মঞ্চে নাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে অভিনয় করে দর্শকনন্দিত হয়েছিলেন।
নজরুলসঙ্গীতে অনবদ্য অবদানের জন্য সোহরাব হোসেন স্বাধীনতা পদক, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা, নজরুল একাডেমী পদক, চ্যানেল আই পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। সংগঠক হিসেবেও রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। নজরুলসঙ্গীত প্রামাণীকরণ পরিষদ ও নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এবং ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.