জিয়াউরের ব্যাটে ছক্কা-বৃষ্টি by আরিফুল ইসলাম

বোলার আর উইকেটকিপার ছাড়া বাকি নয় ফিল্ডার সীমানায়। কারও বুকে হাত, কারও কোমরে, কারও বা পেছনে। একেকটি বল মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
তাঁরা তাকিয়ে দেখছেন আর বল কুড়িয়ে আনছেন। আবার সেই অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা, যেন পরের বলটা কুড়িয়ে আনার অপেক্ষা! জিয়াউর রহমানের ব্যাটে ওঠা ঝড়ে কাল বিকেলে এমনই অসহায় হয়ে গেলেন ওয়ালটন মধ্যাঞ্চলের বোলার-ফিল্ডাররা।
নতুন কিছুর সূচনাটা স্মরণীয় করে তুলতে চাই অভাবনীয় কিছু। ক্রিস গেইলের ৪৪ বলে সেঞ্চুরি যেমন রাঙিয়ে দিয়েছিল গত বিপিএলের উদ্বোধনী দিন। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে সেই কাজটা করলেন জিয়াউর। প্রাইম ব্যাংক দক্ষিণাঞ্চলের অলরাউন্ডার কাল ছক্কা-বৃষ্টিতে সিক্ত করলেন নতুন টুর্নামেন্টের প্রথম দিন আর মিরপুর স্টেডিয়ামকে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারার বিশ্ব রেকর্ডটাও হয়তো করে ফেলতেন। হলো না শেষ সতীর্থ আউট হয়ে যাওয়ায়।
বাঁহাতি স্পিনার মেহরাবের ফুলটসে যখন ফিরতি ক্যাচ দিলেন মুরাদ খান, জিয়ার নামের পাশে তখন ১১৮ বলে অপরাজিত ১৫২। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট তো বটেই, যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেটেই তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি। ৭ চার আর ১৫ ছক্কায় সাজানো জিয়ার অসাধারণ ইনিংসের কল্যাণেই একসময় দুই শর নিচে গুটিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা দক্ষিণাঞ্চলের স্কোর শেষ পর্যন্ত ৩৪৩।
যখন ব্যাট করতে নেমেছেন, স্কোরবোর্ডে তখন ৫ উইকেটে ১৪৯। এরপর যে ১৯৪ রান যোগ হলো, এর ১৫২-ই জিয়ার ব্যাট থেকে! লোয়ার অর্ডারদের সঙ্গী করে অবিশ্বাস্য ব্যাটিং আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ইনিংসটির মহিমা। নিজের শেষ ১৩৫ রান করেছেন শেষ দুই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে। ৫৮ রানের নবম উইকেটজুটিতে রুবেলের অবদান ১৫। ৭৩ বলে ৯৩ রানের শেষ জুটিতে মুরাদের অবদান শূন্য! ভুল পড়েননি, শূন্যই। জুটিতে জিয়ার অবদান ৯২, বাকি ১ রান নো বল থেকে! জিয়ার ইনিংসে মুরাদের বড় অবদান ২৫ বল আর ৫০ মিনিট উইকেটে থাকা।
কাল জিয়া যা করলেন, তা রীতিমতো বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলা। আট-নয়জন ফিল্ডারকে সীমানায় রেখেছেন মধ্যাঞ্চলের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ, কিন্তু মাথার ওপর দিয়ে বল উড়ে গেলে ফিল্ডারদের কী-ই বা করার থাকে! চার-ছয় মেরেছেন, আবার ওভারের পঞ্চম বা শেষ বলে ঠিকই নিয়ে নিয়েছেন সিঙ্গেল। হতাশায় একবার স্টাম্পে লাথি মেরেও বসলেন মাহমুদউল্লাহ!
শুরুটা অবশ্য শান্ত সমাহিত ভঙ্গিতেই করেছিলেন জিয়া। প্রথম ৪০ বলে করেছেন ১৩ রান, যাতে মাহমুদউল্লাহকে পুল করে মারা একটি মাত্র চার। অন্য প্রান্তে নিয়মিত উইকেট পতনে যেন জেগে উঠলেন, আর তাতেই লন্ডভন্ড মধ্যাঞ্চল। শাহাদাতকে হুক করে ছক্কায় ফিফটি ছুঁয়েছেন ৬৬ বলে। ৮৮ বলে এল সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরিতে ৮টি ছক্কা, মাত্র ৩০ বলে করা পরের ৫২ রানে ৭টি!
এসব পরিসংখ্যানে যেমন মনে হচ্ছে, ইনিংসটা দেখে কিন্তু সেটিকে মোটেও আসুরিক কিছু মনে হয়নি। কবজির জোর আর শক্তির প্রদর্শনী তো কিছুটা থাকবেই, তবে এর চেয়েও বেশি চোখ কেড়েছে নিখুঁত টাইমিং। বল নির্বাচন ছিল চোখে পড়ার মতো, নিজের পছন্দের জায়গায় পেলেই শুধু বড় শট খেলেছেন। প্রমাণ—১৫ ছয়ের ১৩টিই লং অন, ওয়াইডিশ লং অন ও বোলারের মাথার ওপর দিয়ে। ৭৫ রানে শাহাদাতের বলে মিড উইকেটে সানিকে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেছেন, ইনিংসে খুঁত বলতে এই একটাই। ছক্কার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত করেননি বলতে গেলে প্রতিপক্ষের কোনো বোলারকেই। মাহমুদউল্লাহ, আশরাফুল ও মেহরাবকে মেরেছেন তিনটি করে, দুটি করে সানি ও মোশাররফকে। বাকি দুটি শাহাদাত ও মার্শালকে।
অথচ দিনের প্রথম ভাগটায় ছিল জিয়ার সতীর্থদের আত্মহত্যার প্রতিযোগিতা। লাঞ্চের পর প্রথম বলেই শাহাদাতকে এমন তেড়েফুঁড়ে পুল করতে গিয়ে আউট হলেন অধিনায়ক ইমরুল, যেন ওই বলে চার মারার ওপর নির্ভর করছে বাঁচা-মরা! তুষার-রাব্বি-মিঠুনরা থিতু হয়েও বিলিয়ে এসেছেন উইকেট। কিন্তু জিয়ার ব্যাটে আড়াল হয়ে গেছে বাকি সবকিছুই। এমনকি ৫ উইকেট পাওয়া মধ্যাঞ্চলের
বাঁহাতি স্পিনার মোশাররফও। বোলিং-কৃতিত্ব ভুলে দিন শেষে গোমড়ামুখে যাঁকে বলতে হলো, ‘ব্যাটিংটা এখন খুব ভালো করতে হবে আমাদের!’
সংক্ষিপ্ত স্কোর
প্রাইম ব্যাংক দক্ষিণাঞ্চল: ৭৩ ওভারে ৩৪৩ (ইমরুল ৪২, সৌম্য ৪, এনামুল ১১, মিঠুন ৩৭, তুষার ৩০, রাব্বি ২৫, জিয়াউর ১৫২*, সোহাগ ১৫, রবিউল ১, রুবেল ১৫, মুরাদ ০; শাহাদাত ২/৬৮, তালহা ১/৩১, সানি ১/৭৬, মাহমুদউল্লাহ ০/৬৪, মোশাররফ ৫/৫২, মার্শাল ০/৭, আশরাফুল ০/২০, মেহরাব ১/২৩)।
বিধ্বংসী জিয়াউর
রান বল চার ছয়
১৫২* ১১৮ ৭ ১৫

No comments

Powered by Blogger.