কালো মানুষের দেশে

(পূর্ব প্রকাশের পর)আফ্রিকার গাবুন নামক রাজ্যের রাজা ছিলেন কিং গ্লাস। উপজাতির প্রজারা বৃদ্ধ রাজাকে নিয়ে একেবারে জেরবার হয়ে পড়েছিল। সবাই ভাবতে শুরু করেছিল রাজা ক্ষতিকর জাদুকর।
তুকতাক মরণউচাটনের শক্তি তার ক্রমশই বাড়ছে। মুখে না বললেও রাজা গ্লাসকে সবাই সন্দেহের চোখে, ভয়ের দৃষ্টিতে দেখত। রাতে তার আস্তানার সামনে দিয়ে কেউ ভয়ে যেত না। তবু রাজা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখন সকলেরই খুব কষ্ট হলো। যদিও প্রজারা মনে মনে চাইতে লাগল বৃদ্ধ রাজার মৃত্যু হোক।
একদিন রাজা মারা গেলেন। তখন রাজার জন্য সকলে তারস্বরে কাঁদছে আর বিলাপ করছে। সারা শহরের মানুষ শোক পালন করতে লাগল। মৃত্যুর দ্বিতীয় দিবসে বিশ্বস্ত কয়েকজন রাজার মরদেহ গোপন কোন এক স্থানে কবর দিল। এমন জায়গায় তাকে কবর দেয়া হলো যে জায়গার সন্ধান কেউ পাবে না। এদিকে রাজ্যে যখন শোক চলছে তখন গ্রামের প্রবীণরা নতুন একজন রাজার অনুসন্ধান করছে। এই রাজা খোজার ব্যাপারটাও খুব গোপনে করা হচ্ছে। তিন-চারজন ছাড়া কেউ জানতে পারে না। সাধারণ মানুষ তা জানতে পারে ছয়দিন শোক প্রকাশের পর সপ্তম দিনে। আর সেই দিনই নতুন রাজার অভিষেক হয়। কিন্তু যাকে রাজা করা হবে সে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারে না। সৌভাগ্য সম্পূর্ণ আচমকা সেই মানুষটির মাথায় মুকুট তুলে দেয়।
নির্বাচকরা নজগোনিক নামে একজনকে গোপনে রাজা নির্বাচিত করলেন। কারণ সে একজন ভাল বংশের ছেলে। তাছাড়া তাকে সকলেই ভীষণ ভালবাসে। ফলে নির্বাচকরা সকলেই তাকে ভোট দিয়েছে। সপ্তম দিন সকালে সে আপনমনে সমুদ্রের তীর ধরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ রাজ্যের প্রায় সকল মানুষের বিশাল একটি দল নজগোনিকে ঘিরে ধরল। ফলে তার আর পালাবার পথ রইল না। শুরু হলো অশ্রাব্য গালিগালাজ। অতি কুৎসিত খিস্তিখেউর। এরপর সবাই তার মুখে তার সর্বাঙ্গে থুতু ছিটাতে লাগল। একই সঙ্গে তার ওপর বর্ষিত হতে লাগল কিল-চড়-লাথি। তার দিকে ছোড়া হতে লাগল যতসব আবর্জনা। ভিড়ের মধ্যে যারা তার নাগাল পাচ্ছে না, তারা গালাগাল দিয়েই সন্তুষ্ট। এই গালাগালি থেকে শুধু নজগোনিকই নয়, তার বাবা-মা-ভাই-বোন-চৌদ্দগোষ্ঠীও বাদ গেল না। কারণ সে এখনও রাজা হয়নি। তাই এই ফাঁকে যে যা পারছে তার ওপর তাই করে নিচ্ছে। কারণ রাজা হওয়ার পর সে যা চাইবে প্রজাদের তাই করতে হবে।
এতসব কা-ের মাঝেও নজগোনিক শান্ত। মুখে তার মৃদু হাসি। একবারের জন্যও সে বিচলিত হচ্ছে না। আধ ঘণ্টা ধরে ওই অনুষ্ঠান চলার পর জনতা নজগোনিকে টেনে নিয়ে গেল মৃত রাজার আস্তানায়। সেখানে তাকে বসানো হলো আসনে। সেখানেও আর একপ্রস্ত অভিশাপ ও গালিগালাজ করা হলো। তারপর সবাই চুপ। উদ্বেল জনসমুদ্র যেন কোন্ মন্ত্রবলে একেবারেই শান্ত। সেই নৈঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন বয়স্করা। ভক্তিভরে নজগোনিকে বললেন, ‘আজ থেকে আপনিই আমাদের রাজা। হে রাজা আমরা আপনার কথা শুনব। আপনার সমস্ত আজ্ঞা পালন করব।’
বৃদ্ধদের প্রশস্তির পর জনতা সকলেই একে একে অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করে নতজানু হলো। আবার নীরবতা। তখন একজন একটি সিল্কের টুপি এনে নজগোনিকের মাথায় পরিয়ে দিল। এই টুপিই রাজকীয়তার প্রতীক। একে একে তাকে পড়ানো হলো রাজপোশাক লাল একটি জোব্বা। এতক্ষণ যারা তাকে কিল-চড়- লাথি মারছিল, থুতু ছিটাচ্ছিল, গালাগাল দিচ্ছিল তারা মাথা নত করে তাকে বিনীত সম্মান জানাতে লাগল। এরপর টানা ছয়দিন ধরে চলল উৎসব। নতুন রাজাকে পুরনো রাজারই নাম নিতে হলো। নজগোনিক বদলে গ্লাস। একনাগাড়ে ছয়দিন ধরে অসংখ্য অতিথিকে তার দরবারে অভ্যর্থনা জানাতে হলো। আপ্যায়নের কোন ত্রুটি থাকলে চলবে না। এক্ষেত্রে রাজা এক প্রকার গৃহবন্দি। প্রজারা এই ছয়দিন শুধু খেয়েই গেল। আকণ্ঠ পান করতে লাগল নিকৃষ্ট ‘রাম’। মাতলামিও চূড়ান্ত। উৎসবের মতো উৎসব। আশপাশের গ্রামের অচেনা মানুষও সেই উৎসবে যোগ দিল। সেই সঙ্গে তারা নিয়ে এলো রাজার জন্য নানা উপহার, মদ, তাড়ি খাবারদাবার।
প্রয়াত রাজা গ্লাস যার জন্য এত চোখের জল ফেলা হলো; তাকে সবাই ভুলে গেল। অন্যদিকে নতুন রাজার এই ছয়দিন ধরে কোন ঘুম নেই, নেই কোন বিশ্রাম। দিবারাত্রি তাকে প্রস্তুত থাকতে হলো অতিথি অভ্যর্থনায়। সারাক্ষণ তাকে ভদ্র ব্যবহার করতে হলো। শেষমেশ এমন হলো যে, তার শরীর আর চলে না। ক্লান্তিতে তার চোখ বুজে আসতে চাইছে। কিন্তু তার বিশ্রাম নেবার উপায় নেই। অবশেষে সব মদ শেষ হয়ে গেল। সমাপ্ত হলো ছয়দিনের উৎসব। রাজাকে বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হলো।
দার্শনিকতার কোন স্তরে পৌঁছলে একজন রাজার অভিষেক এমন হতে পারে? পশ্চিমের শ্বেতসভ্যতার মাথায় তা আসবে না। এ সকল আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটাই বোঝানো হলো যে, প্রথমত যে রাজা চলে গেলেন তার প্রতি মানুষের ক্ষোভ ছিল। অভিষেকের প্রাকমুহূর্তে সেই ক্ষোভ তারা ঢেলে দিল নির্বাচিত রাজার ওপর। নতুন রাজাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো তিক্ত সম্ভাবনার কথা, পূর্বের রাজার দীর্ঘ শাসনে তারা অসন্তুষ্ট। তিনি সম্মানের আসন থেকে স্খলিত হয়েছিলেন ভীতির আসনে। আর নতুন রাজাকে সিংহাসনে বসার পূর্বভাগে জানিয়ে দেয়া হলো প্রজারা বিদ্রোহী হলে কি হতে পারত? একটা হুঁশিয়ারি দিয়ে শুরু হলো নতুন রাজার রাজত্বকাল। জানিয়ে দেয়া হলো- ‘তোমার আসন স্বেচ্ছাচারিতার নয়, আত্মসুখের নয়। তোমার ধর্ম হলো সেবা আর ভালবাসা। তুমি রাজা, তুমি আমাদের পিতা’।
এরপর যে ছয়দিন ধরে উৎসব ও পানাভোজ চলল তারও একটা গভীর অর্থ আছে। এর অর্থ হলো- রাজা তোমার শাসনকালে দেশজুড়ে যেন এমনই প্রাচুর্যের বন্যা বয়ে যায়। বয়ে যায় ভোজ আর পানীয়ের অমৃতধারা। তোমার শাসনকালে শুরুতেই এই অবস্থা, যতদিন যাবে প্রাচুর্যের প্রবাহ যেন বাড়তেই থাকে। প্রজারা যেন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আহার্য পায়। তোমার প্রজারা যেন দুধেভাতে মহাসুখে মহাআনন্দে দিনাতিপাত করতে পারে। (চলবে)
কাওসার রহমান

No comments

Powered by Blogger.