স্বপ্নের শালিমার by মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক

দেখতে দেখতে লাহোরের দিনগুলো কেটে যেতে থাকে। এরই মধ্যে প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। অনেক কিছু দেখা হয়েছে, লাহোরের অনেক জায়গায় ঘোরা হয়েছে কিন্তু এখনও শালিমার গার্ডেনে যাওয়া হয়নি।
মনে মনে ভাবি, এ বাগিচা না দেখে দেশে ফিরে যাওয়া মানে কিছুটা অতৃপ্তি নিয়েই প্রত্যাবর্তন। ছোটকাল থেকে শালিমার গার্ডেনের অনেক গল্প শুনেছি, অনেক সিনেমাতে এ বাগিচায় নায়ক-নায়িকার নৃত্যগীতের দৃশ্য দেখেছি, যে কারণে মুঘলদের এ স্থাপনাটির প্রতি সব সময়ই এক ধরনের টান অনুভব করতাম। বাগান প্রিয় মুঘলদের এটি একটি অনন্য কীর্তি। যদিও একই নামে কাশ্মীর এবং দিল্লীতেও এ ধরনের বাগিচা আছে, তারপরও এ বাগিচাটিই আমাদের কাছে কাছে অনবদ্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল।
এক শনিবার দুপুরে লাঞ্চের পর কড়া রোদ উপেক্ষা করে এ গার্ডেন দেখার জন্য দলে বলে বেরিয়ে পড়ি। গাইড হিসেবে সঙ্গে নিয়েছি আসলামকে। লাহোরের কোথাও বেড়াতে গেলে আসলামই আমাদের সঙ্গ দিয়ে থাকে, কর্তৃপক্ষ সেভাবেই তাকে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দিয়েছে। যদিও সে কোনো প্রফেশনাল গাইড নয়, তারপরও তার সার্ভিসে কোনো ঘাটতি নেই। সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইতিমধ্যে আসলাম আমাদের সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছে। আসলামের নেতৃত্বে আমাদের পর্যটক যান এগিয়ে যেতে থাকে। আমরা যেখানে আস্তানা গেড়েছি সে ওয়ালটন এলাকা থেকে গন্তব্যের দূরত্বও খুব বেশি নয়। মাত্র সাত, আট কিলোমিটারের মতো হবে। মূল শহর থেকে অবশ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এ বাগিচার দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। শহরের ব্যস্ত সীমানা পেরিয়ে শেরশাহের আমলের গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে বাস চলতে থাকে। রস্তার দু’পাশে নজরে পড়ে পুরনো সময়কালের বহুমাত্রিক স্থাপত্যের বাড়িঘর। কিছু কিছু বাড়ির অবস্থা বেশ শোচনীয়, বহুকাল এগুলোতে মেরামতের আঁচড় পড়েনি। কোনো কোনো বাড়ি রীতিমতো ভুতুড়ে বাড়ির মতো মনে হয়। এক সময় এসব এলাকায় প্রচুর শিখ এবং হিন্দু জনগোষ্ঠী বাস করত। মূলত এ শহরে শিখদেরই ব্যাপক সংখ্যক উপস্থিতি ছিল। বিগত শতাব্দীর দেশ ভাগের পর অনেকেই সাত পুরুষের ভিটা ছেড়ে চলে যায়। এ সব এলাকার ঐতিহাসিক বাড়ি ঘর দেখতে দেখতে ধাবমান গাড়ি প্রবেশ করে মোগলপুরা এলাকায়। এ পুরনো এলাকার স্থাপনাসমূহ দেখার সময় মনে পড়ে কৃষণ চন্দনের ‘গাদ্দার’, ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ এবং খুশবন্ত সিংয়ের ‘ট্রেন টু পাকিস্তানের কথা’। মনে পড়ে ১৯৪৭ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা। মনে পড়ে আমাদের পূর্ব পুরুষদের রাজনৈতিক দৈন্যের কথা। ওই সময়কালের মানবিক বিপর্যয়ের কথা মনে পড়লে এখনও মনের অজান্তে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে যেতে থাকি গন্তব্যের পথে। আজকে মুঘলরা নেই, রাজা রণজিতের শিখ রাজত্বও নেই। কিন্তু ওদের অস্তিত্ব বুকে ধারণ করে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এলাকাটি। পুরনো দিনের এ সমস্ত এলাকা দেখতে দেখতে কিছু সময় পর আমাদের মাইক্রোবাসটি বাগবানপুরা এলাকার একটি পুরনো ফটকের সামনে এসে দাঁড়ায়। আসলামের হাঁক ডাকে বুঝতে পারি কাক্সিক্ষত গন্তব্যে এসে গেছি। একে একে সবাই নেমে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি এ ঐতিহাসিক স্থাপনার দেয়ালের দিকে। দেয়ালের দারিদ্র্য দর্শন করে একটু আহত হতে হয়। এত নাম ডাক যে গার্ডেনের, যে গার্ডেন দেখার জন্য মনে মনে এত প্রস্তুতি, এত উদ্দীপনা, তার বাস্তব অবস্থা এমনটি হবে তা কী আর কল্পনাতে ছিল? ভেবেছিলাম এর বহিরাঙ্গন হয়তো হবে চাকচিক্যময়, প্রথম দর্শনেই চোখ জুড়িয়ে যাবে। ক্ষুণাক্ষরেও মনে এ কথা উদিত হয়নি যে, এ স্থাপনার এখন বয়স হয়েছে, তাছাড়া এখন যে মুঘলদের জমানা নয় সে কথাও মনে উঁকি দেয়নি। উচ্ছ্বাসের অতিশয্যে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম যে আমরা একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে যাচ্ছি যার বয়স ইতোমধ্যে সাড়ে তিন শ’ বছর অতিক্রম করেছে। আহত মন নিয়েই অতি সাধারণ এক ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। প্রবেশ পথটিও সাটামাটা। সর্বত্র কেমন যেন অযতœ অবহেলার ছাপ লেগে আছে। এ গার্ডেনের ব্যাপারে মনের গহিনে এতদিন যে জৌলুস লালন করে এটিকে দেখতে এসেছি তা যেন প্রথম দর্শনেই হোঁচট খায়। অগত্যা এর বয়স বিবেচনা করে সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিতে এটিকে না দেখে প্রতœত্বত্ত্বের প-িতের দৃষ্টিতে দেখতে থাকি। একরাশ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকি এর বিন্যাসিত ইটের গাঁথুনির দিকে। এরপর ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে প্রবেশ করি অভ্যন্তরের সুবিশাল চত্বরে। ভেতরে প্রবেশের পর স্থাপনাটির আভিজাত্য দেখে মনের হতাশা অনেকটা দূর হয়ে যায়। যদিও এখানকার কোনো কিছুতেই তেমন একটা যতেœর ছাপ নেই, তারপরও এর পরতে পরতে পরিদৃষ্ট হয় মুঘলদের অনবদ্য স্থাপনা শৈলীর মনোমুগ্ধকর অনিন্দ্য সম্ভার।
এ বাগিচাটিকে পাঞ্জাবি এবং উর্দু ভাষায় শালিমার গার্ডেন নামে অবিহিত করা হলেও কেউ কেউ এটিকে শালামার গার্ডেন নামেও সম্বোধন করে থাকে।
এটি একটি পার্সিয়ান স্থাপত্যধারার গার্ডেন। নির্মিত হয়েছে মুঘল এবং ইসলামিক স্থাপত্য শৈলীতে। নির্মাণ করিয়েছিলেন মুঘল স¤্রাট শাহজাহান। ১৬৪১ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে পরের বছরই তা সম্পন্ন হয়েছিল। মুঘল রাজদরবারের অন্যতম ওমরাহ খলিলুল্লা খানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ বাগিচার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। নির্মাণ কাজে তাকে সহায়তা করেছিল আলী মর্দান খান এবং মোল্লা আলাওল মুলক তুনি। কাশ্মীর, সেন্ট্রাল এশিয়া, পশ্চিম পাঞ্জাব, পারস্য এবং দিল্লীর সালতানাতের ভূ-বৈচিত্র্যের প্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে এ বাগিচার নকশা এবং নির্মাণ কাজ হাতে নেয়া হয়েছিল।
বাহ্যিকভাবে অন্যান্য বাগিচার মতো বাগিচাটি চতুর্ভুজ আকৃতির মনে হলেও এটিকে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে সমান্তরাল নির্মাণ করা হয়নি। এর দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ৬৫৮ মিটার, প্রস্থ পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ২৫৮ মিটার এবং বিপরীত বাহুগুলো পরস্পর সমান। চতুষ্কোণি ধারণার আলোকে এর চত্বর নুবিন্যস্ত। চারিদিকে সুউচ্চ প্রাচীর বেষ্টনীর মাধ্যমে স্থাপনাটিকে রহস্যময় অবয়ব দেয়া হয়েছে। নানা জাতের বৃক্ষরাজির ছায়াময় পরিবেশে এতিম সন্তানের মতো পুরো অঙ্গন এখন মুঘলদের মলিন প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যৌবন ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও এর পুরো অঙ্গে এখনো ঐশ্বর্যের বর্ণচ্ছটা উদ্ভাসিত। পক্ব কেশের অভিজাত রমণীর মতো এর প্রতিটি পরতে ছড়িয়ে আছে মুঘলদের গৌরবময় সৌরভ। যে কারণে ১৯৮১ সালে স্থাপনাটিকে ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।
এ বাগিচার অন্যতম আকর্ষণ তিন স্তর বিশিষ্ট চত্বর। দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরের দিকে এর স্তরবিন্যাস বিন্যাসিত এবং একটি চত্বর থেকে অন্যটি চার-পাঁচ মিটার করে ঢালুতে অবস্থিত। এর এক একটি চত্বরকে এক এক নাম দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে উঁচু স্তরের চত্বরটিকে উর্দুতে বলা হয় ‘ফারাহ বক্স’ যার অর্থ আনন্দ ধাম। মধ্যবর্তী স্তরের চত্বরটিকে বলা হয় ‘ফয়েজ বক্স’ যার অর্থ শুভ চত্বর। সবচেয়ে নিচের স্তরের চত্বরটিকে বলা হয় ‘হায়াত বক্স’ বা দীর্ঘায়ুর চত্বর। এ সমস্ত চত্বরের বিশেষণ অনুযায়ী এক একটি চত্বর এক এক ধরনের বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হতো।
এটিকে শুধুুমাত্র ইট-পাথরের সাদামাটা স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। এখানে ঝরনাধারার ব্যবস্থা ছিল, শ্বেত পাথরে নির্মিত কৃত্রিম লেকে নৌবিহারের ব্যবস্থা ছিল এবং সে সঙ্গে ছিল সুবিস্তৃত অঙ্গনজুড়ে সবুজের অনাবিল সমারোহ। এ সমস্ত সবুজ ঘাস, ফুলের গাছ, অন্যান্য বৃক্ষরাজি এবং ফোয়ারার জন্য সে কারণে পর্যাপ্ত জল সরবরাহেরও ব্যবস্থা রাখতে হয়েছিল। যে খালের মাধ্যমে এখানে জল সরবরাহ করা হতো সে খালটিকে বলা হতো শাহ নহর। শাহ নহর’র বাংলা অর্থ দাঁড়ায় রাজকীয় খাল।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.