মরুঝড় ॥ মোহিত কামাল- স্বপ্ন ভেবে চারপাশ দেখতে থাকল উত্তরে মসজিদের অনন্য সুন্দর মিনার, দখিনে মালিক-বাড়ির সুউচ্চ সিঁড়িঘর। ওই বাড়িতে কবার কাজ করতে ঢুকেছিল রুস্তম। দুবাইয়ের কলি হাসতে হাসতে বলেছিল মাঝে মাঝে আমি উঠি সিঁড়িঘরে

 (পূর্ব প্রকাশের পর) রুশনা বেগম বললেন, কেন, মিথ্যা কী বললাম। আমার শত অনুরোধে দরজা খোলোনি। অথচ শৌর্যের কথায় দরজা খুলে দাওনি তুমি? মিথ্যা কী বললাম?
ঝাপটা দিয়ে শাশুড়ির হাত থেকে মুঠোফোনটি কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে কলি বলল, শুনেছেন আপনার মায়ের কথা? হিমালয় সমান উঁচু শ্রদ্ধাভাজন আপনার মা-কে কি আমি অপমান করলাম? নাকি কুটনি মনের কূটচালের কারণে নিজেকেই অপমান করছেন তিনি? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিতা করে তোলার জন্যই গোপন ঈর্ষা কাজ করে তাঁর মনে। ঈর্ষার আগুনে কেবল আমাকে নয়, আপনাকেও পোড়াবেন তিনি, বুঝতে পারছেন?
চিৎকার করে রুস্তম জবাব দিল, খবরদার! আর একটি কথাও বলবে না আমার মা-কে নিয়ে।
আকাশে ওঠা চাঁদ যেন ভেঙে খান খান হয়ে পড়ল এ বাড়ির ছাদে। কিছুণ দাঁড়িয়ে থেকে কলি বুঝতে পারল শাশুড়ি সামনে নেই। মুঠোফোন নিয়ে চলে গেছেন নিজের রুমে। আবেগশূন্য কলি একাকী দাঁড়িয়ে ভাবল, কী ঘটে গেল জীবনে! জীবন কি এ রকই ! ভাবতে গিয়ে কষ্টের জমাট চাকে ঢিল পড়ল। চাক ভেঙে টুপটুপ ঝরতে থাকল কষ্টের নোনাজল। অসহায় লাগছে না নিজেকে। যার কচি বুকে এমন কষ্ট জমা হতে পারে, অসহায় হবে কেন সে? বরং কষ্ট পাওয়াও তো একটা অভিজ্ঞতা। নির্মম কষ্টের অভিজ্ঞতায় যে সম"দ্ধ হতে পারে, সে কেন শূন্য হবে? অসহায় হবে? সে তো ঐশ্বর্যবান! নিজেকে ঐশ্বর্যবান ভেবে ঋদ্ধ হলো কলির মন। এই ঋদ্ধের গোপন ঘরে অংকুরিত হলো ােভ আর মহাবিস্ফোরণের নতুন কলিÑ নিজেকেই চিনতে পারছে না কলি। নতুন কলি দখল করে নিয়েছে পুরোনো কলির পুরো সত্তা। নতুনভাবে জেগে উঠে হো হো হেসে উঠল পুরোনো কলি। নতুন আর পুরাতনের দ্রোহ-মিলনে অন্য রকম হয়ে গেল আসল কলি।


আকাশে কখনো মেঘ দেখা যায় না। মরুঝড়ের কারণে বালির উড়ালন"ত্য মেঘের মতো ঘূর্ণি তুললেও আসল মেঘের দেখা মেলে না এই মরু প্রান্তরে। চেনা রোদ্দুরের চেনা তাপে পুড়তে পুড়তে আপন মনে মসজিদের বাইরের বাগানে কাজ করছিল রুস্তম। হঠাৎ টের পেল আকাশে জমেছে উড়ন্ত মেঘ। রোদ্দুরে পোড়া রুস্তম হঠাৎ মেঘের ছায়ায় নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে উঠল। বাইরের রোদের চেয়ে ভেতরের দহনে ছাই ভস্ম হতে থাকা রুস্তম পেল শীতল পরশ। মায়ের অভিযোগ শোনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে পুড়ে পুড়ে ছাই হতে থাকা রুস্তমের মনে হল, ভেতরের আগুন নিভে গেছে। কীভাবে নিভল, বোঝার সুযোগ না পেয়ে, বাইরের চোখ দিয়ে দেখে নিল চারপাশ। অসাধারণ কিছুই নজরে এল না। প"থিবী চলছে আপন নিয়মে। অথচ ভেতরটা ঠা-া হয়ে গেল কেন? বাইরের মেঘও কি তবে থামিয়ে দিতে পারে পুড়তে থাকা তুষের আগুন? মেঘের মধ্যে ভর করে কি সুদূর বাংলাদেশ থেকে উড়ে এসেছে কলি? শৌর্যের সঙ্গে সম্পর্কের কথা কি তবে মিথ্যে? এত ছোট কিশোর-দেবরের সঙ্গে আদৌ হতে পারে কোনো সম্পর্ক? মনের মধ্যে উদয় হওয়া চিন্তা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেঘ কুঞ্জ ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ধারণ করেছে নারী মূর্তিতে? কে এই নারী?
কলি! হ্যাঁ কলিই তো!
এটা কি স্বপ্ন?
স্বপ্ন ভেবে চারপাশ দেখতে থাকলÑউত্তরে মসজিদের অনন্য সুন্দর মিনার, দখিনে মালিক-বাড়ির সুউচ্চ সিঁড়িঘর। ওই বাড়িতে একবার কাজ করতে ঢুকেছিল রুস্তম। দুবাইয়ের কলি হাসতে হাসতে বলেছিল মাঝে মাঝে আমি উঠি সিঁড়িঘরে। মসজিদের দিকে তাকাই। কখন আপনাকে দেখা যাবে, জানি আমি। যখন মনে খুশি থাকবে, সিঁড়ি-ঘরে দাঁড়িয়ে দেখে নেব আপনাকে। আপনি তাকালেই দেখতে পাবেন আমাকে। আমার হাতে থাকবে লাল রুমাল। লাল রুমাল উড়লে বুঝবেন আমি দাঁড়িয়ে দেখছি আপনাকে। এই মুহূর্তে ওই বাড়ির দিকে তাকিয়ে লাল রুমাল দেখার চেষ্টা করল রুস্তম। দেখা গেল না। প্রায় এমন হয়। লাল রুমাল দেখার সুযোগ হয়নি রুস্তমের। তবুও আকাড়ার ঘরে কখনো কখনো গোপনে উড়তে থাকে লাল রুমাল। ভাবনায় লাল রুমাল উড়ে এসে জুড়ে বসার পর তুষের আগুনের দাপট একটু একটু বাড়তে লাগল। ভেতরের দহন টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের দিকে তাকাল রুস্তম। আশ্চর্য! আকাশের নারী মূর্তি উধাও হয়ে গেছে। উড়ন্ত মেঘের জমাট ছায়া হালকা হয়ে রোদের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে!
শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল। পোড়া মনে ত"ষ্ণা কমে গেলেও এ মুহূর্তে পানি পান করার ই"ছা হলো। বাগানের এক পাশে খেজুর গাছের আড়ালে রাখা ব্যাগের দিকে চোখ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল স্বপ্নে নয়, বাস্তবের মাঠে কাজে ব্যস্ত আছে সে। পানি খেয়ে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে উড়ন্ত মেঘে ভেসে আসা নারী মূর্তির মধ্যে আসল কলিকে আবিষ্কারের চেষ্টা করল। আসল কলির মেঘমূর্তি উড়ে গেলেও কলির কথাগুলো শব্দ বুলেটের মতো আক্রমণ করল চাহিদার গোপন দরজায়Ñ‘আপনাকে লাগবে। আপনিই বড় ওষুধ। ওই ওষুধ ছাড়া পড়ে থাকলে কলি আর কলি থাকবে না। পাপড়ি খুলে ঝরে যাবে। ঝরা কলি দেখে কি মন জুড়াবে আপনার?’
মিরাকল! বাংলাদেশের কলির স্খলন হয়েছেÑ ভাবনাটি উড়ে গেল। মনে হলো মন-প্রাণ সঁপে দেওয়া বাংলাদেশের কলি অনেক বেশি ঐশ্বরিক মতা সম্পন্ন। কলির মনের জোর অনেক বেশি শক্ত। ওর টানে ঘাটতি নেই। উড়াল মেঘের ভেলায় ভেসে সে ছায়া দিয়ে গেছে তাকে। মনের আগুন কমিয়ে দিয়ে গেছে। এসে চলে গেলেও, মন তৃপ্ত হলেও, তৃপ্তির ফাঁক দিয়ে আবার মনের পর্দায় ভেসে উঠল লাল রুমালের কথা। লাল রুমালের ভাবনার পরই উড়াল মেঘখণ্ড উড়ে গেল কেন? তবে কি বাংলাদেশের কলি টের পেয়ে গেছে দুবাই কলির হাসির ঝড়ে তার স্বামীর মন-দূষণের খবর? সবই কি টের পেয়ে যায় সে? এমন মেয়ে কি কোনো পাপ করতে পারে? স্খলিত হতে পারে শৌর্যের মতো ছোট ছেলের হাত ধরে? চিৎকার-ধ্বনি হয়ে প্রি গতিতে উত্তর বেরিয়ে এল একদম ভেতর থেকেÑনা।
সঙ্গে সঙ্গে পকেটের মুঠোফোনে রিংটোন বেজে ওঠল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেট বের করে চোখের সামনে তুলে ধরা মাত্রই কেঁপে উঠল রুস্তম। কন্ট্রলরুম থেকে কল করেছেন চিফ অফিসার। কল ধরার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী রুস্তম? এমন লাগছে কেন তোমাকে? মনিটরে দেখতে পা"িছ তোমার অদ্ভুত আচরণ। মন খারাপ হয়েছে? অসু¯' মনে করছ নিজেকে?
কাজে অমনোযোগী হলে মনিটরিং সেলের চিফ অফিসার সবাইকে চমকে দিয়ে এভাবে কথা বলেন। সজাগ করে দেন, জানে রুস্তম। এই কলে ভয়ের কিছু নেই। সচেতন হয়ে জবাব দিল, প্রবল ত"ষ্ণা পেয়েছিল। অ¯ি'র লাগছিল। পানি খাওয়ার পর ভালো লাগছে এখন।
ঠিক আছে। খারাপ লাগলে গাছের ছায়ায় বসে কিছুণ বিশ্রাম নাও। প্রয়োজনে ছুটিও নিতে পারো। তোমার কর্মত্রে তো বন্দীশালা নয়। বুঝলে?
চিফ অফিসারের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ চোখ গেলে মালিক বাড়ির সিঁড়িঘরের দিকে। লাল রুমাল উড়ছেÑ দেখল রুস্তম। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে দেখল সে। এই মুহূর্তে মনিটরিং সেলের স্ক্রিনে নিজের প্রতিটি অভিব্যক্তি ভেসে উঠছে, বোঝার অসুবিধে হলো না। ভেতর থেকে বাধা পেয়ে ঘুরে বসল বাঁয়ে। রেস্ট নি"েছ সে। আচমকা আবার বেজে উঠল রিংটোন। ভেবেছিল চিফ অফিসার কল করেছে আবার। মনিটরের দিকে না তাকিয়ে ইয়েস বাটনে চাপ দিয়ে কানের সঙ্গে মুঠোফোন লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল খিলখিল হাসির শব্দ...
কে! চমকে প্রশ্ন করল রুস্তম।
চিনলেন না? আমি কলি।
কলি?
হ্যাঁ, দুবাইয়ের কলি। ডানে ঘুরে বসুন। দেখুন লাল রুমাল উড়ছে। চট করে বাঁয়ে ঘুরে গেলেন কেন? লাল রুমাল তো প্রথমে দেখেছিলেন। উড়ন্ত লাল রুমাল কি দেখার ই"ছা নেই? দুবাই কলিকে কি... কথা শেষ না করে আবারও খিলখিল হেসে ওঠল কিশোরীটি।
আরেকবার ডানে তাকালে নিশ্চিত চিফ অফিসারের চোখে ধরা পড়ে যাবে লাল রুমাল-উপ্যাখ্যান। ভেবে বলল, এখন তাকানো যাবে না। চিফ অফিসারের মনিটরিং পর্দায় ভেসে আছি আমি। আমার চোখ অনুসরণ করে আপনাকে দেখে ফেলবেন তিনি। বিপদ হবে আমার। চাকরি খোয়ানোর ভয় তো আছেই। গর্দান কাটা যওয়ার ভয়ও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
আমার দিকে তাকালে গর্দান কাটা যাবে। না তাকালেও কাটা যাবে।
কী বলছেন আপনি?
সত্যি বলছি। আমার দিকে তাকালে চিফ অফিসার আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করবে। আর না তাকালে আমি অপমানবোধ করব। কষ্ট পাব। আরেকটু বাড়িয়ে বাবাকে বলব, আপনি আমার সঙ্গে... করার চেষ্টা করেছেন। কিংবা বলেই বসতে পারি, জোর করে আমাকে ... করেছেন। বুঝলেন?
রুস্তম জবাব দিল, সেকি? এমন কিছু তো করিনি আমি। নিরাপরাধী আমাকে কেন বিপদে ফেলবেন? (চলবে...)

No comments

Powered by Blogger.